স্থানীয় পর্যায়ে (আমাদের বর্তমান কাঠামো অনুযায়ী গ্রাম, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা, সিটি করপোরেশন ইত্যাদি) বা স্থানীয় এলাকার উন্নয়নে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসনের পরিপ্রেক্ষিতে যে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তাকে স্থানীয় পরিকল্পনা বা Local Planing বলা হয়। খুব সরল ভাষায় আমরা আঞ্চলিক পরিকল্পনা বা এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনাও বলতে পারি। একটি দেশের কোনো বিশেষ অঞ্চলের জন্য অথবা বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য আলাদা আলাদা পরিকল্পনা তৈরি করা এখানে প্রধান বিষয়। স্থানীয় পরিকল্পনার ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা যদি তাত্ত্বিকভাবে স্থানীয় পরিকল্পনার ধারণাকে বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব, এখানে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, মতামত প্রদান ও সহযোগিতা থাকে। স্থানীয় প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত থেকে ও জনগণের মতামতের ভিত্তিতে যথাযথভাবে কোনো কাজ করার সুযোগ পান। স্থানীয় পরিকল্পনার দ্বারা কর্তৃপক্ষ ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব কমে যায়। ফলে গণতান্ত্রিক চর্চা সফল হয় ও সবার মাঝে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষ পরিকল্পনা বলতে বেশির ভাগ সময় জাতীয় পরিকল্পনা বোঝে। জাতীয় পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের বিশেষ অংশগ্রহণ থাকে না। জাতীয় পরিকল্পনা হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কেন্দ্রভিত্তিক, মুষ্টিমেয় লোকের পরিকল্পনাভিত্তিক ও আমলাতান্ত্রিক। জাতীয় পরিকল্পনা খুব খারাপ বা সম্পূর্ণ বর্জন করতে হবে- এমনটা কিন্তু বলা যাবে না। জাতীয় পরিকল্পনারও দরকার আছে। তার প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন। তবে স্থানীয় পরিকল্পনাকে উপেক্ষা করে জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাবে না। স্থানীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ প্রতিনিয়ত নিজের মতামত প্রদানের সুযোগ পায়। মতামত প্রদানের এই সুযোগ শুধু কথা বলার সুযোগ নয় বরং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ। এ সুযোগ যখন সাধারণ মানুষ পায় তখন পুরো রাষ্ট্রকাঠামো সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যক্তির সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে। শুধু জাতীয় পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করে স্থানীয় এলাকার উন্নয়ন করা যায় না। জনগণের দারিদ্র্যবিমোচন, বেকারত্ব হ্রাস, অবকাঠামোগত কার্যক্রমসহ বিভিন্ন স্বল্প ও দীর্ঘকালীন পদক্ষেপ গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয় সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে গেলে পরিকল্পনা একমুখী হওয়া চলবে না। একমুখী পরিকল্পনার মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা বিঘ্নিত হয় ও বাস্তব পরিস্থিতির পর্যালোচনা কম থাকে। ফলে পুরো উন্নয়ন কার্যক্রম হয় জনবিচ্ছিন্ন ও ধীরগতিসম্পন্ন। যদিও তাতে ব্যাপক গতি থাকে তবু তাকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে এবং এ ধরনের প্রচেষ্টা পুরো রাষ্ট্রকাঠামোকে সমাজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তা ছাড়া ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা বসে থাকেন তারা সমাজের সার্বিক উন্নতিতে মনোযোগী না হয়ে যেনতেন উপায়ে (প্রয়োজনে সমাজে অপরাধপ্রবণতা ও অন্ধবিশ্বাস ছড়িয়ে) নিজেদের উন্নতিতে মনোযোগী হন। অর্থাৎ দেশের উন্নয়ন পরিণত হয় মুষ্টিমেয় লোকের উন্নয়নে। রাজনীতি শাস্ত্রের পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরা এক্ষেত্রে বলতে পারি : গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ব্যতিরেকে প্রকৃত উন্নয়ন অসম্ভব। স্থানীয় পরিকল্পনা হলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা। মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবার উন্নয়ন, বাসস্থান সমস্যার সমাধান, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্থানীয় পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। কেবল জাতীয় পরিকল্পনা দ্বারা বিষয়গুলো করতে চাইলে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতা ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই স্থানীয় পরিকল্পনা সম্পর্কে সারা বিশ্বে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। পরিকল্পনা যখন ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন বাজারকে অধিক প্রাধান্য দেওয়া বা কিছু পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা থাকে। সাধারণ মানুষের প্রয়োজনকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না এক্ষেত্রে। মানুষ চাহিদা অনুযায়ী দ্রব্য ও সেবা পায় না। দেখা যায়, গোটা উৎপাদন প্রক্রিয়া তথা আর্থিক কার্যক্রম মানুষের জীবনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। স্থানীয় পরিকল্পনা এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। এক্ষেত্রে আরেকটি কথা না বললেই নয়, বর্তমানে প্রয়োজনীয় পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ নিশ্চিত করতেও স্থানীয় পরিকল্পনার বিকল্প নেই। অধিকাংশ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়ন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয় সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে। স্থানীয় পরিকল্পনা এই গুরুতর সমস্যার সমাধান দিতে পারে। স্থানীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একত্রিত করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব। এর ফলে পুঁজিতন্ত্রের অবিকশিত অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানুষের জীবনমান নিম্নমানের থাকে ও মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব হয় অনুন্নত পুঁজিতন্ত্রের কারণে। পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ রুদ্ধ থাকার ফলে মানুষ অধিক নির্যাতিত হয়। সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি প্রগতিশীল জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এই জাতীয় পরিকল্পনা কীভাবে তৈরি করতে হয়? কেননা জাতীয় পরিকল্পনা যদি উন্নয়নকে ত্বরান্বিত না করতে পারে বা পুঁজির ত্বরান্বিত বিকাশ না ঘটাতে পারে তাহলে এর নৈতিক ভিত্তি থাকে না। এ সমস্যার সমাধান হলো স্থানীয় পরিকল্পনা। স্থানীয় পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত স্থায়ীভাবে সংগ্রহ করা হয়। ফলে পরিকল্পনা বেশ সুদূরপ্রসারী হয়। এ অভিজ্ঞতা সরাসরি কাজে লাগানো যায় জাতীয় পরিকল্পনায়। স্থানীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে উৎপাদন, বণ্টন, বিনিময় ও ভোগের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। দেশের প্রতিটি অঞ্চল বা বলয় বিশেষ কোনো উপকরণে বা কারণে সমৃদ্ধ হয়। মানুষের সংস্কৃতি ও চিন্তাধারায়ও ভিন্নতা থাকে। মানুষের চাহিদা ও সামর্থ্য বাকি অঞ্চলের সঙ্গে মেলানো চলে না। স্থানীয় পরিকল্পনায় পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মানবিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সম্পদের জোগান সব সময় বিবেচিত হয়। এগুলো বিবেচনা করলে রাষ্ট্রের পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশে যারা সংবিধান ও রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ে কাজ করেন তারা যদি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগে জনগণের অংশগ্রহণের ব্যাপারে সচেতন হন তাহলে স্থানীয় পরিকল্পনা সফল হবে ও দেশের অগ্রযাত্রা সুনিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের সংবিধান ভাবনায় ও রাষ্ট্রকাঠামো ভাবনায় ব্যাপারটা অর্ধেক হয়েই আছে। পুরোটা করতে পারলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
লেখক : গবেষক