চুরি-ডাকাতি নিয়ে কোনো কিছু লিখতে বসলেই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি দেশাত্মবোধক গানের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি লিখেছেন, ‘এই দেশেরই ধূলায় পড়ি- মানিক যায়রে গড়াগড়ি, বিশ্বে সবার ঘুম ভাঙালো- এই দেশেরই জিয়নকাঠি।’ আসলে এই দেশে মণি-মানিক্যের তথা সম্পদের ছড়াছড়ির কারণে ছোটবেলাতেই মায়েরা ঘুমপাড়ানি গানের সুরে গাইতেন, ‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিব কিসে?’ -দেশের সম্পদ রক্ষায় সতর্ক না থেকে ঘুমিয়ে থাকলে বর্গিরা দেশে এসে সব লুটপাট করে নিতে পারে ভেবে সবাইকে সতর্ক করতেই হয়তোবা মায়েরা এমন গান বানিয়েছিলেন। তবে আজ বর্গির বদলে দরবেশ আসে। তারপর কী এক জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় দায়িত্ববানরা ঘুমিয়ে থাকে কিংবা ঘুমের ভান করে, আর চুরি হয়ে যায় হাজার হাজার কোটি টাকা। আজকের প্রেক্ষাপটে অবাক হওয়ার উপায় নেই যদি কোনো মা এমনটা গেয়ে ওঠেন, ‘গভর্নর ঘুমালো, দুদক ঘুমালো- দরবেশ এলো দেশে, এস আলমরা টাকা সরালো- ব্যাংক বাঁচবে কীসে?’
ব্যাংকের টাকা সরে গেলে কোন আইনে কী বিচার হবে বা কে কে শাস্তি পাবে- তা ভাবলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। আইনজ্ঞরা নিশ্চয়ই এ নিয়ে বিচারকদের সামনে যুক্তিতর্কের যুদ্ধে নামবেন। কারণ ব্যাংকে যে টাকা থাকার কথা তা নেই। এটা কি চুরি? না প্রতারণা? না হারানো? না গুম? ধরা যাক বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ তছনছ প্রসঙ্গে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বিদেশের দুটি অ্যাকাউন্টে চলে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি ২৪ দিন গোপন রাখে, ৩৩তম দিনে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে জানায়, ৩৯তম দিনে দেশীয় চিফ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করে এবং এর ছয় বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে। জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এজন্য ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ২৭ মে বাংলাদেশ ব্যাংকে মামলা করতে পেরেছে (সূত্র : প্রথম আলো, ৪ মার্চ ২০২৪)। তবে জুলাই মাস পর্যন্ত ৭৯ বার তারিখ পেছানো হলেও তদন্ত সংস্থা সিআইডি কোনো প্রতিবেদন দিতে পারেনি। এ ঘটনায় চোর কে, গৃহস্থ কে, আর পুলিশ কে- এই তিন প্রশ্নের উত্তর ৩০০ এমনকি ৩০০০ পৃষ্ঠার গবেষণার পরও মিলবে কি না প্রশ্ন রয়েছে। আর সিআইডি অবশ্যই অহংকার করে বলতে পারেন আমরা তো এখনো সেঞ্চুরি করিনি। সাগর-রুনির হত্যার সঙ্গে তাদের ল্যাপটপও চুরি হয়েছিল, যেখানে অনেক রাঘববোয়ালের চুরির প্রমাণ ছিল। তারা তো ল্যাপটপ চুরি রহস্য তথা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন ১১৩ বার মেয়াদ বৃদ্ধির পরও তো জমা দিতে পারেনি। বরং আবারও সময় পেয়েছে। তারা সময় পেলে আমরা পাব না কেন?
একটু আইনের বই খুলে দেখলাম বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৯ নম্বর ধারায় কেউ চুরি করলে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় প্রকার দণ্ড দেওয়া যায়। সবাই যখন বলছি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছে, তখন ৩৭৯ নম্বর ধারায় তিন বছর কারাদণ্ড দিলেই কি মামলা খতম? আর ৩৭৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি, কোন ব্যক্তির দখল হইতে কোন অস্থাবর সম্পত্তির উপর উক্ত ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে অসাধুভাবে গ্রহণ করিবার অভিপ্রায়ে অনুরূপ গ্রহণের উদ্দেশ্যে উক্ত সম্পত্তি স্থানান্তর করে, সেই ব্যক্তি চুরি করে বলিয়া গণ্য হইবে’। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হারানো, চুরি, ডাকাতি, গুম না ছিনতাই হয়েছে- তা নিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। বিভিন্ন কারণে চোর ও চুরি শব্দটি সাম্প্রতিক সময়ে বারবার মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাধান্য পাচ্ছে। পাট, বস্ত্র ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন অতিসম্প্রতি বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি যা দেখেছি, এটাকে সাগর চুরি বলা যায় না, প্রশান্ত মহাসাগরীয় চুরির জায়গা এগুলো।’ সেনাবাহিনীর সূত্রে স্যার আমাদের একান্ত শ্রদ্ধার পাত্র এবং শিক্ষকতুল্য। স্যারের ভুল ধরার ধৃষ্টতা নয়, একান্ত অনুধাবনের জন্য বলছি, পুকুর, সাগর বা মহাসাগর হলো স্থাবর সম্পত্তি। আর আইন (বিপিসি-৩৭৮) বলে চুরি হয় অস্থাবর সম্পত্তি। বাংলাদেশে যদি, নালা, খাল, বিল, খাসজমি, আস্ত ব্রিজ এমনকি চাকরির স্বপ্নও চুরি হয়ে যায়। তখন তা স্থাবর সম্পত্তি। তাই কারও কিছু বলার নেই। সংস্কার কত দিকে কতভাবে প্রয়োজন, তা ভাবতেও অবাক লাগে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে থাকা পান দোকানদারের ছাতা হারানো অবশ্যই চুরি। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ‘চুরি’ হয় কোন বিচারে? টাকা কি গুম হয়? কে জানে?
অতিসম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিদ্যালয় ও পার্বত্য খাগড়াছড়িতে চারজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণ হারানো দুই ছাত্র বিগত দিনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিল। এ অপরাধে কাউকে পিটিয়ে মারা বর্বরতার শামিল। তার চেয়ে বড় কথা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের অনেকেই আবার প্রকান্তরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে কি অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য এমনটা করা হলো? নাকি নিজেদের ছাত্রলীগ-বিরোধী ও বৈষম্যবিরোধী প্রমাণ করতে রং পাল্টানোর প্রচেষ্টা- তা তদন্ত করা জরুরি।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও খাগড়াছড়িতে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয় দুই যুবককে। এ দেশে চুরি করলেই যদি পিটিয়ে মারার বিধান হতো, তবে গণকবর দিয়েও মৃতদেহ সামলানো যেত না। এমন বর্বরতা রোধে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ প্রয়োজন। এ দুটি ক্ষেত্রেও সুযোগসন্ধানীরা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য এমনটা করা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ডের আগে নিকটাত্মীয়দের কাছে টাকা দাবি আর অমানুষিক নির্যাতন করে মৃত্যুর ঘটনা নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে, যার উত্তর খোঁজা জরুরি।
চুরি নিয়ে অতিসম্প্রতি ‘আলিবাবা চল্লিশ চোর’ গল্পটি নতুন করে সামনে এসেছে। আরব্য রজনির এই গল্পে ‘মর্জিনা’ নামের চরিত্র নাচে-গানে ভুলিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত ডাকাতদের হত্যা করে। এতে রক্ষা পায় আলিবাবার ধন-সম্পদ। সম্প্রতি এ দেশের অন্যতম আলিবাবা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এস আলমের এক গৃহপরিচারিকার নামে ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা নগদ ও ফিক্সড ডিপোজিটের তথ্য পাওয়া গেছে। সেই পরিচারিকার নামও মর্জিনা। বাংলাদেশে একসময় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যান ডব্লিউ মজীনা। তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরাও তাকে ‘কাজের ছেড়ি মর্জিনা’ বলে ব্যঙ্গ করতেন। এ দুই সূত্রে বলাই যায়, ‘ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট দি পাওয়ার অব মর্জিনা।’
জুলাই মাসের শেষ দিকে সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা যুক্তরাষ্ট্রের টাইম টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর প্রধানকে সৈন্যদের নিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার উপদেশসহ নানাবিধ পরামর্শ দিয়েছিলেন। এরই এক ফাঁকে তিনি বলেন, এমন আন্দোলন ও ডামাডোলের মধ্য দিয়ে হয়তো নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের জন্ম হবে; আবার হয়তোবা পুরনো দলগুলোর পুনরুত্থান হবে- ইত্যাদি ইত্যাদি। তখনই সচেতন মহল ধারণা করেছিল, বাংলাদেশে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনাকে ‘মর্জিনা’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর অন্যদিকে কোটিপতির তালিকায় থাকা মর্জিনা (এস আলম), পরিচ্ছন্নতা কর্মী গনি মিয়া (ঢাকা সিটি করপোরেশন-দক্ষিণ), ড্রাইভার আবেদ আলী (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) কিংবা শত কোটি টাকার মালিক পিওন জাহাঙ্গীর (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়)- এমন চল্লিশ বা চার শত, ৪ হাজার কিংবা ৪ লাখ চোরের উত্থান শেখ হাসিনার পতনের জন্য কতটুকু দায়ী তা ইতিহাস এক দিন অবশ্যই বিচার করবে। ভুলে গেলে চলবে না ‘চোরের দশ দিন, সাধুর এক দিন’।
ইদানীং আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষ বিনোদনের খোরাক হয়েছেন একশ্রেণির চোর, যাদের ‘মন চোর’ বলা যায়। এদের একজন আবার ছিলেন চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতির তথাকথিত নেত্রী। ক্ষমতাধর একটি পরিবারের সদস্য এবং একসময়কার মন্ত্রী ও বিগত সংসদের সদস্য বর্ষীয়ান এক রাজনৈতিক নেতার মন চুরি করেছিলেন তিনি। আর এ কারণে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর বিশেষত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ফাইল এই মন চোর শিল্পী তথা নেত্রীর আঙুলের ইশারাতেই চলত বলে মুখরোচক গল্প ছড়িয়েছে। মন চোর এই শিল্পীর বিউটি পারলার উদ্বোধন করেন এই রাজনৈতিক নেতা। আরেক জাত শিল্পীকে সুদূর লন্ডন থেকে ফোন করে ওই শিল্পী তার মন চুরি করেছে বলে জানিয়েছিলেন বিগত মন্ত্রিসভার এক প্রবীণ মন্ত্রী। সিনেমা না করেও এক তথাকথিত শিল্পী মন চুরি করেছিলেন এক রসিক বড় মন্ত্রী ও ক্ষমতাধর নেতার। এই শিল্পীর বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন সদা ব্যস্ত মন্ত্রী মহোদয়।
লেখাটা শেষ করব এক ধরনের বুদ্ধিজীবীর কথা বলে, যারা একদিকে নিজেরা চুরি করেছেন আবার অন্যদিকে তাদের বিবেক-বুদ্ধি যে চুরি হয়ে গেছে মর্মে ধারণা করা যায়। তারা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বসে ন্যক্কারজনকভাবে অন্যের লেখা নিজের বলে চালিয়ে দিতে কখনো পিছপা হতেন না। এমনকি বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তকের বইয়ে গুগল থেকে নেওয়া এবং অনুবাদ করা লেখা নিজেদের রচনা বলে ছাপিয়ে দিতেও কখনো কুণ্ঠিত হননি। কোন ধরনের চোর এমনটা করতে পারে, ভাবা যায়?
সমীর রায়ের লেখা এবং প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সুর ও গায়কিতে মনে দাগ কাটা একটা গান মনে পড়ল। চোরদের দলীয় সংগীত হতে পারে এমন গান :
আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখর খানি
বেচোনা বেচোনা বন্ধু তোমার চোখের মণি।
কলা বেচো, কয়লা বেচো, বেচো মটরদানা
বুকের জ্বালা বুকেই জ্বলুক, কান্না বেচোনা।
ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে, হাজার টাকায় সোনা
বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচোনা।
ঘরদোর বেচো ইচ্ছে হলে, করব নাকো মানা
হাতের কলম জনম দুঃখী, তাকে বেচোনা।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email : [email protected]