আমি যেখানে থাকি সেই এলাকায় কিছুদিন আগে তিনটি বাড়ি নির্মাণকাজের জন্য ভাঙা হয়েছে। সেখানে ডেভেলপাররা নতুন ভবন তুলবেন। বাসা ভাঙার পর ইট-কাঠ-পাথর সব সরানো হয়েছে। কিন্তু বাড়ির জমিতে বড় বড় গর্ত রয়ে গেছে। সেখানে বৃষ্টির পানি জমে আছে। বেড়েছে মশার উৎপাত। চারদিকে জ্বর-জারির খবর পাচ্ছি, অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে। ঘরের মাঝে আমার নাতনি রুহানী জ্বরে আক্রান্ত হলো। পরিবারের সবার মারাত্মক দুশ্চিন্তা আমাদের ১৮ মাস বয়সি কনিষ্ঠ সদস্যটিকে নিয়ে। ছুটে গেলাম শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আবিদুর রহমান মোল্লার কাছে। গিয়ে দেখি অনেক শিশুই এসেছে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। যেখানে বড়দের অসুখ মেনে নেওয়াই কঠিন, সেখানে মাসুম বাচ্চাদের অসুস্থ মুখ-বুক ভেঙে দেয়। ডাক্তার সাহেব ডেঙ্গু টেস্ট করতে বললেন। পরীক্ষার জন্য রুহানীকে নিয়ে গেলাম আইসিডিডিআরবিতে। ছোট্ট বাচ্চার হাতে রক্তের শিরা খুঁজে না পেয়ে পা থেকে রক্ত নেওয়া হলো। তার কষ্ট দেখে আমরা মুষড়ে পড়লাম। পরীক্ষার রিপোর্ট এলো ডেঙ্গু নয়, ভাইরাল ফিভার। কিন্তু হাসপাতালে অনেক শিশুই ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়ছে। এ সময়ে নাকি শিশুরাই বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে সিটি করপোরেশনের কাজে স্থবিরতা। মশার ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না। রাস্তার ময়লা-আবর্জনাও ঠিকঠাক পরিষ্কার হচ্ছে না। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও একই অবস্থা। ফলে বাড়ছে ডেঙ্গুর বিস্তার। সারা দেশেই ডেঙ্গু এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। আগে ডেঙ্গু আতঙ্ক শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক হলেও এখন প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়ে গেছে। আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জানতে পারছি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪) নতুন ভর্তি রোগীদের নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৫৫৫ জনে। মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩৮ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩৬৫ জন, ঢাকা বিভাগে ২০০ জন, ময়মনসিংহে ৩৫ জন, চট্টগ্রামে ৯৮ জন, খুলনায় ৬৪ জন, রাজশাহী বিভাগে ২৭ জন, রংপুর বিভাগে ১০ জন ও বরিশালে ৫৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে ২৯১৫ জন রোগী। গত এক দিনে মৃতদের দুজন ঢাকা বিভাগের। চলতি সেপ্টেম্বরে এখন পর্যন্ত বছরের আগের যে কোনো মাসের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। এ সময় মৃত্যুও হয়েছে বেশি। দেশজুড়ে বুধবার পর্যন্ত ১৩ হাজার ৭১৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৫৫ জনের।
যে কোনো দুর্যোগেই প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষকে সচেতন করা। আমরা টেলিভিশনে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করতে ফিলার তৈরি করে প্রচার করছি। ডেঙ্গু নিয়ে টেলিভিশন, পত্রিকায় নানান প্রচার অভিযান চলছে। কিন্তু কে জানে কেন মশার বিস্তারের খড়গটা এসে পড়ে ছাদকৃষির ওপর। বছর তিনেক আগেও ডেঙ্গুর প্রকোপ যখন চরমে মিরপুর থেকে এক গৃহিণী আমাকে ইমেইলে লিখলেন ছাদকৃষিতে এডিস মশার বংশবিস্তার হচ্ছে এমন অভিযোগে তার ছাদকৃষি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। শুধু মিরপুর থেকে নয়, যাত্রাবাড়ী থেকে একজন ফোনে জানালেন প্রতিবেশীরা তার ছাদকৃষিকে মশার বংশবিস্তারের জন্য দায়ী করছে।
ছাদকৃষি নিয়ে কাজ করছি সেই আশির দশক থেকে। তখন বলতাম ‘ছাদবাগান’। কারণ সে সময় এটা যতটা না ছিল প্রয়োজনের, তার চেয়ে বেশি ছিল শখ বা বিলাসের। কিন্তু বর্তমান সময়ে যখন বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে, প্রশ্ন উঠেছে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে, এমনকি এই সময়ে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে- যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বৈশ্বিক বসবাসযোগ্য প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪০টি শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৩৯। তখন সেটা আর শখ বা বিলাসের পর্যায়ে নেই। সারা বিশ্বই এখন ছাদকৃষি বা নগরকৃষির বিষয়টিতে সচেতন ও সোচ্চার। তাই ছাদকৃষি হয়ে উঠেছে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। দেশের বিভিন্ন শহরের ছাদকৃষি দেখেছি। দেখেছি অবসরে চলে যাওয়া সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, কিংবা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নিজেদের অবসর সময়টাকে ফলপ্রসূ করে তুলছেন ছাদে এক টুকরো ছাদকৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। তারা বলেছেন, ছাদকৃষি দিয়েছে আত্মিক প্রশান্তি। যার নিজস্ব ভবন ও ছাদ রয়েছে তারা নিজেদের ছাদে এক স্তর বা দ্বিস্তরবিশিষ্ট ছাদকৃষি গড়ে তুলছেন। আবার যাদের নিজস্ব বাড়ির ছাদ নেই, তারা বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে ছাদের এক পাশে বা বারান্দায় গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ছাদকৃষি। এই ছাদকৃষি দিয়ে তিনি খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন, মিটছে পারিবারিক পুষ্টি, পাচ্ছেন মানসিক প্রশান্তি। পাশাপাশি পালন করছেন একটা জাতীয় দায়িত্ব। শহরকে সবুজায়ন ও নগরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করছেন। এক চিলতে ছাদের একদিকে চাষ হচ্ছে ফুল, অন্যদিকে ফল, বাদ যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় সবজির আবাদও। সঙ্গে ছাদের এক কোণে নানান ঔষধি গাছ-গাছরাও লাগাচ্ছেন অনেকে। অনেকেই গাছের পাশাপাশি মাছের চাষও করছেন ছাদে। ছাদকৃষির ভূমিকা অর্থনৈতিকভাবে যতটুকু তার চেয়েও বেশি সামাজিক মেলবন্ধনে। কৃষির চর্চা মানসিক প্রশান্তি দেয়। কৃষির সান্নিধ্য মনের বর্জ্য দূর করে।
যা হোক, এডিস মশার বিস্তারে ছাদকৃষি বিষয়টিও এখন আলোচনা-সমালোচনায় এসেছে। ছাদকৃষি ও ছাদভিত্তিক মাছ চাষের প্রকল্পে এডিস মশা বংশবিস্তার করতে পারে এমন আশঙ্কায় জনমনে ছাদকৃষি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু গবেষণা ও তথ্যপ্রমাণ বলছে ভিন্ন কথা। পরিকল্পিত ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিয়ে তৈরি ছাদকৃষিতে এমন ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যারা ছাদকৃষি করেন, তাদের ছাদ অপেক্ষা বাগানবিহীন ছাদ বেশি অপরিষ্কার ও অধিক ঝুঁকিসম্পন্ন। কারণ ছাদকৃষি উদ্যোক্তারা নিয়মিত ছাদে যান এবং ছাদে লাগানো গাছপালার যত্ন ও পরিচর্যা করেন। যারা সত্যিকার অর্থে ছাদকৃষির সঙ্গে যুক্ত তাদের ছাদের টবে কখনোই পানি জমে থাকে না। কারণ তারা জানেন টবে পানি জমলে গাছের ক্ষতি, গাছ মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে যে ছাদে ছাদকৃষি নেই, সেই ছাদে কেউ তদারকি ও পরিচর্যা করে না, যার ফলে ছাদ থাকে অপরিচ্ছন্ন।
গত কয়েক বছরে আমি ৪ শতাধিক বাড়ির ছাদে গিয়েছি, যারা ছাদকৃষি করেন। ছাদে এমন কোনো টব বা ড্রাম দেখিনি যেখানে পানি জমে আছে। তারপরও যারা ছাদকৃষি করছেন তাদের প্রতি পরামর্শ থাকবে ছাদকৃষির টবের মাটি প্রস্তুতির সময় যদি ৫% মাটি, ৮০% নারকেলের ছোবড়া বা তুষ, ১০% বালি এবং ৫% জৈব সার দিয়ে প্রস্তুত করেন, তাহলে অল্প পানি ব্যবহারেই টব অনেক সময় ধরে ভেজা থাকবে। টবের নিচে ছিদ্র থাকলে পানি কখনোই জমে থাকবে না। ছোট ও লতাজাতীয় গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে তলানি ও পাশে ছিদ্রযুক্ত ঝুলন্ত টব ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়াও টবের পাশাপাশি একদিকে ঢালু অবকাঠামো তৈরি করেও গাছ লাগানো যেতে পারে অথবা টব বসানোর ভিত্তিটি সামান্য একদিকে ঢালু রাখা যেতে পারে। এর ফলে টবে আর পানি জমার সম্ভাবনা থাকবে না। ছাদে লাগানোর জন্য উপযুক্ত গাছ নির্ধারণেও কিছু বিষয় খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়। যে গাছগুলো কম পানিতে হয়, যেমন- ড্রাগন, অ্যালোভেরা, মরিচ, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি প্রজাতির গাছ ছাদে বেশি লাগাতে পারেন। অন্যদিকে অতিরিক্ত ঝোপ সৃষ্টি করে এমন প্রজাতির গাছ লাগানো থেকে বিরত থাকুন। আপনারা হয়তো জানেন, কিছু প্রজাতির গাছ যেমন লেবু গাছ, গাঁদা ফুল, লেমন গ্রাসের গন্ধ মশা সহ্য করতে পারে না। তাই ছাদে অন্যান্য গাছের সারির মাঝে মাঝে মশা তাড়ানোর জন্য এ ধরনের গাছ লাগাতে পারেন।
ছাদে মাছের ট্যাংক বা চৌবাচ্চায় এডিস মশার ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। মাছের ট্যাংকের পানিতে মাছ বেশির ভাগ সময়ই চলমান থাকে, যার ফলে পানিতে স্রোত ও ঘূর্ণন তৈরি হয়। আমার বাসার ছাদেও ছোটখাটো একটা ছাদকৃষি আছে। আমার স্ত্রী পারু সারা দিনই তা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বলাবাহুল্য, সতেজ ও নিরাপদ খাদ্যের তাগিদ এবং সবুজের সান্নিধ্যে মানসিক প্রশান্তি লাভের জন্যই এ ছাদকৃষির আয়োজন। অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে ছাদকৃষি হওয়ায় ছাদের ট্যাংকে কিছু মাছেরও চাষ করা হচ্ছে। সেখানে আমি লক্ষ্য করেছি, এডিস মশা যেহেতু বদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে তাই মাছ চাষের ট্যাংকে এদের ডিম পাড়ার সম্ভাবনা নেই। এতেও যদি ঝুঁকি থেকে যায় তবে ট্যাংক বা চৌবাচ্চায় অ্যারেটর ব্যবহার করা বা মোটর দিয়ে কৃত্রিম পানির স্রোত বা ঝরনা তৈরি করা যেতে পারে। এতে মশা জন্মানোর ঝুঁকি যেমন কমবে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে ছাদের সৌন্দর্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মশা নিধনে গাপ্পি, মসকুইটো ফিশ ও অন্যান্য লার্ভাভুক মাছ নালা নর্দমা বা বদ্ধ জলাশয়ে ছাড়ার নজির দেখা যায়। কারণ, মশার ডিম ও লার্ভা এদের অতিপ্রিয় খাদ্য। এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ফিলিপাইনের বিভিন্ন ফিশারিজ অর্গানাইজেশন সেদেশে নালা-নর্দমায় গাপ্পি মাছ ছাড়ার ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। গাপ্পি, মসকুুইটো ফিশ ছাড়াও আমাদের দেশীয় খলিশা মাছ মশার ডিম ও লার্ভা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গাপ্পি মাছ আমদানি করা হয়েছিল মশা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই, যা এখন একটি জনপ্রিয় অ্যাকুরিয়াম মাছ। অবিভক্ত ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মশা নিধনে বাংলাদেশের নালা-নর্দমায় গাপ্পি মাছ ছাড়ার উদ্যোগ নেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ২০১৭ সালে একটি গবেষণায় বিভিন্ন ড্রেন ও নর্দমার প্রচন্ড নোংরা পানিতে প্রচুর পরিমাণ ‘মশাভুক মাছ’ পাওয়া গিয়েছিল যার ওপর পরীক্ষার ফলস্বরূপ মশা নিধনে এসব মশাভুক মাছের ব্যবহারের চিন্তা আরও জোরদার হয় আমাদের দেশে। তাই এ ধরনের মাছের প্রজাতি এডিস মশা থেকে বাঁচতে ছাদকৃষিতে লালন করা যেতে পারে। গাছে পানি সরবরাহের জন্য নালা বা চ্যানেল তৈরি করেন অনেকেই। এক্ষেত্রে সেসব নালা বা চ্যানেলে গাপ্পি ও অন্যান্য লার্ভাভুক মাছ ছাড়া যেতে পারে।
আমাদের অধিকাংশই নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করি না। নিজের বাড়ির আঙিনা ও চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা নাগরিক দায়িত্ব। যে কোনো সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে আগে যে বিষয়টি দরকার তা হলো সবার সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ। ছাদকৃষি উদ্যোক্তাদের সচেতন থাকতে হবে যেন ছাদের কোথাও টবে বা ড্রামে পানি না জমে থাকে। ছাদকৃষিকে ডেঙ্গুর ঝুঁকিমুক্ত রাখতে প্রয়োজন সচেতনতা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। ছাদকৃষি যেমন আমাদের শহরের জন্য প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা।
♦ লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব