প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরে শিশুদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল। তিনি এ বিশ্ব চরাচরে রহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে তাশরিফ এনেছেন। মহান রাব্বুল আলামিন, প্রতিপালনকারী হিসেবে যেমন সর্বজনীন, ঠিক তেমনিভাবে মহানবীর প্রেম-ভালোবাসাও মানবতার জন্য সর্বজনীন। একবার মহানবী (সা.)-এর কানে হজরত হোসাইন (রা.)-এর কান্নার শব্দ এলো, এতে তিনি ভীষণভাবে ব্যতীত হলেন, তিনি হজরত ফাতিমা (রা.)-কে বললেন, তুমি কি জানো না, তাঁর কান্না আমাকে বড়ই কষ্ট দেয়। হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শিশু-কিশোরদের কাছ দিয়ে গমনকালে তাদের সালাম দিতেন। (বুখারি ও মুসলিম) একবার মহানবী (সা.) ভাষণ দেওয়ার নিমিত্তে মিম্বরে আরোহণ করেন এবং দেখতে পেলেন যে, হাসান ও হোসাইন (রা.) দৌড়াদৌড়ি করছেন এবং পা পিছলে পড়ে যাচ্ছেন, তিনি তৎক্ষণাৎ ভাষণ দান বন্ধ করে মিম্বর থেকে নেমে এলেন, শিশু দুটির দিকে অগ্রসর হয়ে দুই বাহুতে উঠিয়ে নিলেন, তারপর মিম্বরে আরোহণ করে বললেন, হে লোক সব! তোমাদের ধনসম্পদ এক পরীক্ষার বস্তু। আল্লাহর বাণী সত্য। আল্লাহর শপথ, আমি আমার এই দুই নাতিকে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না, তাই দৌড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়ার আগেই এদের দুই হাতে উঠিয়ে নিলাম (বুখারি ও মুসলিম) একদিন রসুলুল্লাহ (সা.) নামাজ আদায় করছিলেন, আর তখন হজরত হাসান ও হোসাইন (রা.) এসে তাঁকে সিজদারত অবস্থায় পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রিয় নানাজির পিঠে চড়ে বসলেন। তিনি সিজদা দীর্ঘায়িত করলেন, আর তারা খেলা শেষ করে পিঠ থেকে খুশিমনে না নামা পর্যন্ত তিনিও তাদের নামিয়ে দিলেন না। অতঃপর প্রিয় নবী (সা.) সালাম ফিরালেন। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল! আমরা লক্ষ্য করলাম যে, আপনি নামাজের সিজদা দীর্ঘায়িত করেছেন। তিনি উত্তরে বললেন, আমার নাতিদ্বয় আমাকে সওয়ারি বানিয়ে খেলা করছে এবং আনন্দ পাচ্ছে। কাজেই তাদের খেলা নষ্ট করে তাড়াতাড়ি নামিয়ে দেওয়াটা আমি চাইনি। হজরত হাসান হোসাইনের কান্না শুনে রসুলের মমতাময়ী দিল হাহাকার করে উঠত। এতে তিনি তার কলিজার টুকরা হজরত ফাতেমা (রা.)-এর প্রতিও ক্ষুব্ধ হতেন। একদা এক সকাল বেলা রসুলে কারীম (সা.) হজরত ফাতেমা (রা.)-এর ঘরের পাশ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, আর তখনই তার কানে হজরত হুসাইন (রা.)-এর কান্নার আওয়াজ এলো, নবীজি তা বড়ই অপছন্দ করলেন। তিনি ফাতেমাকে ডেকে ভর্ৎসনার সুরে বললেন হে ফাতেমা! তুমি কি জানো না, যে তার ক্রন্দন আমার মনে ব্যথা দেয়, আমার বড়ই কষ্ট হয়। তার প্রতি যত্নবান হও। তাকে শান্ত কর। হজরত আনাস (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর তুলনায়, সন্তান-সন্ততির প্রতি অধিক স্নেহ, মায়া-মমতা পোষণকারী আমি আর কাউকে দেখিনি। প্রিয় নবীর পুত্র হজরত ইব্রাহিম মদিনার উঁচু প্রান্তে ধাত্রী মায়ের কাছে দুধ পান করতেন। তিনি প্রায়ই সেখানে যেতেন এবং আমরাও তার সঙ্গে যেতাম। তিনি ওই ঘরে যেতেন, অথচ সেই ঘরটি প্রায়ই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। কারণ ইব্রাহিমের ধাত্রী মায়ের স্বামী ছিল একজন কর্মকার। প্রিয় নবী নিজ সন্তান ইব্রাহিমকে কোলে তুলে নিতেন এবং আদর করে চুমু দিতেন। কলিজার টুকরা পুত্রধনকে অকৃত্রিম পিতৃস্নেহ দিয়ে আদরে আদরে ভাসিয়ে দিতেন। পরম মমতায় বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরতেন। পুত্রের শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করতেন। নয়ন ভরে দেখে চোখের শীতলতা লাভ করতেন। হজরত ইব্রাহিমও যেন পিতার পবিত্র স্পর্শ, পরম মায়া মমতা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাবার কোলে ঘুমিয়ে যেতেন। মহানবী (সা.) সর্বোচ্চ শান্তি ও নিরাপত্তার চাদরে আবৃত করে স্বীয় পুত্রকে তাদের কাছে রেখে বিদায় হতেন। বর্ণনাকারী বলেন, যখন হজরত ইব্রাহিম ইন্তেকাল করেন, তখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইব্রাহিম আমার পুত্র। সে দুধ পান করার বয়সে ইন্তেকাল করেছে। সুতরাং জান্নাতে তাকে একজন ধাত্রী দুধ পান করাবে। (বুখারি ও মুসলিম) হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রসুলে কারীম (সা.)-এর নেতৃত্বাধীন কোন যুদ্ধে এক মহিলাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেল, এতে রসুলে কারীম (সা.) গভীরভাবে মর্মাহত হন এবং নারী ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করেন। প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের যত্ন নিবে এবং তাদের আদব-কায়দা-শিষ্টাচার শিক্ষা দিবে। মহানবী (সা.) আরও এরশাদ করেন, তোমরা তোমাদের শিশুদের ভালোবাসো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন কর। তাদের সঙ্গে কোনো ওয়াদা করলে, তা পূর্ণ কর। কেননা তারা তোমাদের রিজিক সরবরাহকারী বলে জানে। প্রতিটি প্রাণীর মা-বাবাই তাদের সন্তানের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ ভালোবাসা, মায়া-মমতা তাদের সন্তানদের জন্য দান করে থাকেন। প্রতিটি মা-বাবাই সন্তানকে জন্মদাতা হিসেবে ভালোবাসেন। আর আল্লাহতায়ালা তার সৃষ্টি জগৎকে স্রষ্টা হিসেবে ভালোবাসেন। যদি পৃথিবীর সমগ্র সমুদ্রের পানি পরিমাণ ভালোবাসা আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি জগতের জন্য হয়ে থাকে, তো সেখান থেকে সুচ বরাবর এক বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী জগতের জন্মদাতা মা-বাবাকে আল্লাহতায়ালা দান করেছেন। অবশিষ্ট ভালোবাসা আল্লাহতায়ালা তার জন্য রেখে দিয়েছেন।
লেখক : ইমাম ও খতিব কাওলারবাজার জামে মসজিদ দক্ষিণখান, ঢাকা