অনেক আগেই ভারতে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করেছিলাম। ইচ্ছা ছিল ঈদের ছুটিতে কলকাতায় ঘুরে আসব। আমার নানা ব্রিটিশ রেলওয়েতে চাকরির সুবাদে দীর্ঘদিন কলকাতায় ছিলেন। আমার মায়ের লেখাপড়ার প্রথম পাঠ সম্পন্ন হয় কলকাতায়। তাদের কাছে ছোটবেলায় কলকাতার অনেক গল্প শুনেছিলাম। আমার নানা-নানি ১৯৪৭ সালে ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রেলের বিশাল বাংলো বাড়ির পেছনে মাটির নিচে সোনা-দানা পুঁতে এপারে চলে আসেন। কারণ তখন রাস্তাঘাটে এমন দেশ ছাড়া পরিবারের সর্বস্ব লুট করত ডাকাতের দল। নানা-নানির মতো অনেকেই ভেবেছিলেন সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে এবং তারাও আবার কলকাতায় ফিরবেন। সোনা-দানা সবই ফেরত পাবেন। বাস্তবে সেরকম আর হয়নি। ছোটবেলায় সেই গুপ্তধন উদ্ধারের স্বপ্ন দেখতাম মাঝে মাঝে। তাই কলকাতা দেখার শখ ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই।
অনেক দেরিতে ভিসা পাওয়ায় পাল্টে যায় সবকিছু। ঈদের ছুটি পার হয়ে যায় ভিসা পাওয়ার আগেই। মনের আগ্রহ কমতে থাকে বিভিন্ন কাজের চাপে। এরপর শুরু হলো বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব। সেই বিপ্লবের রেশ না কাটতেই কলকাতা উত্তাল হয়ে ওঠে এক চিকিৎসক ধর্ষণ ও পরবর্তীতে খুন হওয়ার ঘটনায়। ফলে অনিশ্চিত হয়ে যায় কলকাতা যাত্রা। এদিকে ভিসার মেয়াদ শেষ দিকে। তাই এক সহকর্মী কলকাতা যাবেন শুনে ভাবলাম আমিও ঘুরে আসি। যা কিছু দেখা যায় তাতেই খুশি।
খুব ভোরেই বাসে করে যাত্রা করেছিলাম। কিন্তু সকাল হলেও ঠিকই আটকা পড়লাম ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার আগেই। দীর্ঘ যানজটে বসে থাকলাম প্রায় ৪০ মিনিটের বেশি। মনে পড়ল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন সম্মানিত শিক্ষকের কথা। হলিস্টিক বা সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ছাড়া খণ্ড খণ্ড উন্নয়ন করলে জনগণ কাঙ্ক্ষিত সুফল থেকে বঞ্চিত হয় বলে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে সেই আমলের রক্তচক্ষু ও চাটুকারদের চোটির আঘাত পাওয়ার ভয়কে তোয়াক্কা না করে পদ্মা সেতু ও ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের উদাহরণ টেনে সাহসী এই শিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, যদি ঢাকায় ঢুকতে বা ঢাকা থেকে বের হতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, তবে এমন সেতু বা ব্যয়বহুল সড়ক নির্মাণের সাফল্য অনেকটাই ম্লান হয়ে যাবে। কলকাতার উদ্দেশে পদ্মা সেতুর দিকে যাত্রার শুরুতে এবং শেষে ঠিকই রাস্তায় আটকা পড়তে হয়েছিল আমাদের। দেশে এখন নতুন নতুন অনেক লেখক, গবেষক, বিশ্লেষক, কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও ইউটিউবারের আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু দেশের প্রয়োজনে বুয়েটের সেই স্যারদের মতো কাঙালদের বড় অভাব, যাদের কথা বাসি হলেই ফলে। তবু যা সত্য, যা বলা উচিত, তা সহজ সরল ও বোধগম্য ভাষায় নির্ভয়ে বলেন ও লিখেন।
ফরিদপুর পার হয়ে যাত্রাবিরতি হলো একটি সুরম্য রেস্তোরাঁয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস যেসব রেস্তোরাঁর সামনে বিরতি দেয়, তার মান উন্নতই হয়ে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখলাম ব্যতিক্রম! ভবনটি উন্নত ও ব্যয়বহুল হলেও ভিতরের ওয়াশরুম থেকে খাবারের মান, সবই ছিল নিম্নমানের। কিন্তু কেন এমন প্রশ্ন যখন মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তখনই পাশের একজন বলে উঠলেন ‘স্বাধীনতার পর এই অবস্থা’। আমার বিস্মিত চেহারা দেখে তিনি যা বললেন, তার সারমর্ম হলো, স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা এই রেস্তোরাঁ একপ্রকার জোর করেই দখল করেছিলেন এবং ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত এখানে রমরমা ব্যবসা চলত। দিনে রাতে ২৪ ঘণ্টা পাজেরো গাড়ির ঢল নামত এই রেস্তোরাঁর সামনে। কিন্তু ইদানীং তিনি সপরিবারে লাপাত্তা। ফলে ক্রমেই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে এই রেস্তোরাঁর জৌলুস। মনে পড়ল টিভিতে দেখা গাজী টায়ার কারখানার আগুন আর লুটপাটের দৃশ্য। কানে বাজল কামাল মজুমদারের কান্না বিজড়িত আর্তনাদ। আজ তার খামারের কোটি কোটি টাকার গবাদিপশু, মাছ সবই অবাধে লুটপাট হচ্ছে। এভাবে যদি মব জাস্টিস আর জঙ্গলের আইন চলতে থাকে, তবে এর চড়া মূল্য দিতে হবে আগামী প্রজন্মকে, যারা অনেক ত্যাগের বিনিময়ে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।
সিন্ডিকেট বেনাপোলের দুই পাশেরই এক অতি পরিচিত শব্দ। বেনাপোলে ঢোকার ঠিক আগেই একটা যানজটে পড়েছিলাম। অনেকক্ষণ লাগবে অথচ সামনে অল্প রাস্তা। তাই সবার মতো আমিও বাস থেকে নেমে একটি অটোরিকশা করে গ্রামের ভিতর দিয়ে ঘুরানো-পেঁচানো রাস্তা ধরে বেনাপোল সীমান্তচৌকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে কথা হলো অটোরিকশা চালকের সঙ্গে। তার বর্ণনাতেই জানা গেল, এই বেনাপোল হলো বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র। এখানে বাতাসে টাকা, রুপি, ডলার সবই উড়ে। যে যেটা ধরতে চায়, ধরতে পারে। প্রতিনিয়ত প্রচুর ওষুধ আসে ভারতের দিক থেকে। এ ছাড়াও মোবাইল এবং ইলেকট্রনিক পণ্য হরহামেশা ঢুকছে। প্রচুর পোশাক ও রকমারি প্রসাধনসামগ্রী নানা কায়দায় ঢুকে বাংলাদেশের সীমানায়। একটি বড় ব্যবসা হলো আদম পারাপার। বিশেষত জুলাই বিপ্লবের পর বিভিন্ন সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে গোপনে সীমান্ত পার করে ওপারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশের নেতার মান, মর্যাদা, পদ ও পদবি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে সীমান্ত পারাপারের দাম ওঠানামা করে। একসময় ছোট্ট একটি খালের পাশ দিয়ে অটোটি এগিয়ে যাচ্ছিল বেনাপোলের সীমান্তচৌকির দিকে। অটোচালকের কথায় ডানে তাকাতেই দেখলাম রাস্তার পাশে খালের ওপারে সীমান্তের কাঁটাতার। অটোচালক বললেন রাত নামলেই এই খাল তথাকথিত ডুবুরিদের দখলে চলে যায়। তবে সব সময় নয়, একটি নির্দিষ্ট সময়ে যখন উভয় দিকের সীমান্তরক্ষীরা অন্যদিকে সরে যায়।
বেনাপোলে সীমান্ত পারাপারের অংশটুকু ছিল একেবারেই ফাঁকা। বরাবরই শুনে এসেছি মোটামুটি কয়েক ঘণ্টা হাতে সময় নিয়ে বেনাপোলে আসতে হয়। কারণ সব সময়ই সেখানে ভারতমুখী মানুষের ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু এবারের বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণই ভিন্ন। মানুষের ভিড় ছিল না। ইমিগ্রেশনের বুথগুলো মোটামুটি ফাঁকাই ছিল। কয়েকটি বুথে আবার কেউ ছিলই না। পেছনে বসে গল্প করছিলেন কয়েকজন ইমিগ্রেশন পুলিশের সদস্য। আমি একটি ফাঁকা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যেতেই আমার পাসপোর্ট দেখে ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন জিজ্ঞেস করলেন আমার পেশা কী। যেহেতু পাসপোর্টে প্রাইভেট সার্ভিস দেখা আছে, আমি সেটাই বললাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, আপনার অফিসের ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ (এনওসি) দেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম এনওসি তো জানামতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বেসরকারি কারও জন্য এনওসি লাগবে বলে তো আমার জানা ছিল না। তিনি বললেন, তাহলে যাওয়া যাবে না। তখন রসিকতা করেই বললাম ধরেন, আমার চাকরি নাই। তিনি বললেন, তাহলে পাসপোর্টের পরিবর্তন করে লিখে আনতে হবে। এবারও রসিকতা করে বললাম ধরুন চাকরি খুঁজছি, হয়তো পেয়েও যাব কিছুদিনের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে কি আবার আমার পেশা পরিবর্তন করে পাসপোর্ট সংশোধন করব? এবার তিনি আমার চেহারার দিকে চোখ তুলে দেখলেন। সম্ভবত আমার দেহের গঠন বিশেষত উচ্চতা দেখে কিছু একটা বুঝে নিলেন। বললেন ঠিক আছে এবারের মতো যান। আবার কলকাতা থেকে ফিরে আসার পথে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পুলিশের এক সদস্য ফাঁকা কাউন্টারে আমাকে পেয়ে সরাসরি কফি খাওয়ার টাকা চেয়ে বসলেন। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম তিনি পুলিশের পোশাকের বদলে সাধারণ শার্ট-প্যান্ট পরে কর্তব্য পালন করছেন। ফলে ইউনিফর্মের সঙ্গে ওই ব্যক্তির যে নামটা লেখা থাকে, তা দেখার সৌভাগ্য হলো না। ধরে নিলাম তার নাম মাসুদ। আর তখনই কানে বেজে উঠল ভাইরাল একটা গান ‘ভালো হয়ে যাও মাসুদ তুমি, এ কথা কে বলবে আর পালিয়ে গেছে...’।
অনেকেই ভারতে পালিয়ে গেছে বলে শুনেছিলাম। তবে আমার ধারণা ছিল যেহেতু ভারতীয় দূতাবাস থেকে নতুন কোনো ভিসা দেওয়া হচ্ছে না এবং বেনাপোলেও তেমন ভিড় দেখা যায়নি, সেহেতু হোটেলে বুকিং পেতে তেমন বেগ পেতে হবে না। কিন্তু সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। কলকাতায় যাওয়ার পরপরই বাংলাদেশিদের কাছে অতি জনপ্রিয় পার্ক স্ট্রিট, মার্কুইস স্ট্রিট, কলিন্স স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট প্রভৃতি এলাকায় যেসব হোটেল ছিল, তার বেশ কয়েকটি ঘুরে একটিতে ঠাঁই পেলাম। ঢাকার সব প্রসিদ্ধ হোটেল-রেস্তোরাঁর নামে খাবারের হোটেল খুলেছেন কলকাতার বাবুরা। খেতে বসে কানপাতলেই বাংলাদেশের কোনো নেতাকে কে কোথায় দেখেছেন, তা শুনতে পাওয়া যায়। জানা গেল বড় নেতা ও পরিচিত মুখের সবাই বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছেন। হোটেলে কেউ কেউ থাকলেও রুমেই খাবার আনিয়ে নেন, বের হন না। তবে হোটেলে মাঝারি ও ছোট নেতারা জীবনের ভয়ে ঠাঁই নিয়েছেন। ৮৯ দিনের মধ্যে তাদের বাংলাদেশে অবশ্যই ফিরতে হবে বলে অনেকেই দুশ্চিন্তায় আছেন।
কলকাতা যাওয়ার আরেক উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার জেলখানায় আটক এক পরিচিতজনের তথ্য নেওয়া এবং সম্ভব হলে সাহায্য করা। অত্যন্ত গরিব পরিবারের মেয়েটি কারও পাল্লায় পড়ে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে। এরপর থেকে জেলে। প্রথম দিকে কেউ খোঁজ না পেলেও পরে জানা যায় দমদম সংশোধনী কেন্দ্রে (জেলে) আছে এই মেয়েটি। বাবা-মার কাছে শিশুসন্তান রেখে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে সে ভারতের পথে পা বাড়িয়েছিল। এখন দমদমে তার দম বের হওয়ার অবস্থা। কারণ অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে শাস্তি ভোগের সময় জেলে এক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। তখন সেখানে বেশ গোলযোগ, দাঙ্গা, জেল থেকে পালানো ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে পরবর্তীতে একটি মামলা হয়। মেয়েটির বর্ণনা মতে ভারতীয় এক আসামি ও তার নাম একই ছিল। ওই মামলায় সেই ভারতীয় জড়িত থাকলেও ভুল কিংবা কূটকৌশলে তাকে অভিযুক্ত করা হয়, আর একই নামের ভারতীয় মেয়েটি মুক্তি পায়। অত্যন্ত কঠিন ধারায় এই মামলা করা হলেও ইতোমধ্যে মামলার আসামি অনেকেই জামিন পেয়েছেন। তবে তার জামিন মিলবে কি না সন্দেহ। কারণ বাংলাদেশি হওয়ায় মেয়েটি জামিনের পর কোথায় থাকবে এবং তারিখে তারিখে কীভাবে হাজিরা দেবে এই প্রশ্নটি জটিল করে তুলেছে মুক্তি প্রক্রিয়া।
মেয়েটির পরিবার আমাকে সব জানানোর পর আমি কলকাতায় স্থাপিত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে কথা বলি এবং তাদের পরামর্শক্রমে ইমেইল যোগে মেয়েটির জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের কপি প্রেরণ করি। ডেপুটি হাইকমিশন কূটনৈতিক চ্যানেলে বাংলাদেশ থেকে মেয়েটির পরিচয় নিশ্চিত হয়ে প্রায় এক বছরে দুটি চিঠি (নোট ভারবাল) লিখেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে। এর বাইরে আর কিছু করার নেই ডেপুটি হাইকমিশনের। মনে পড়ল একজন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা, যিনি সরকারপ্রধান হয়েও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মহামান্য আমিরের সঙ্গে কথা বলে মুক্ত করে আনেন আদালতে রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ জন বাংলাদেশিকে।
মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, সৌদি আরব ও সুলতানাত অব ওমানে প্রায় এক যুগ চাকরির সুবাদে জানতাম বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহের একটি কাজ হলো জেলে আটক বাংলাদেশি নাগরিকদের আইনি সহায়তা প্রদান ও তাদের মুক্ত করে দেশে ফিরে আসতে সাহায্য করা। এজন্য অর্থ বরাদ্দ করে সরকার। ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত মাসুদ নামের একজন কর্মকর্তা এজন্য অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। প্রতি মাসেই তিনি জেলখানায় যেতেন এবং তার কাছে আটক ব্যক্তিদের সর্বশেষ খবর পাওয়া যেত। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন খুবই পরোপকারী। বলা যায় মাসুদ নামের এমন ভালো মানুষ বর্তমানে হয়তো খুবই বিরল। আমি কলকাতা বাংলাদেশ দূতাবাস গিয়ে জানলাম তাদের এমন সেবা প্রদান করার সুযোগ নেই।
দমদম জেল থেকে একটা ফরম নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে এসেছিলাম তাদের অনাপত্তিসংক্রান্ত চিঠি পেতে। এমন চিঠি পেলেই কেবল বাংলাদেশি কোনো আটক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করা সম্ভব। আমি নিকটাত্মীয় নই বলে প্রথমেই আমাকে দূতাবাসের গেট থেকে জানানো হলো এমন কোনো অনাপত্তিপত্র আমাকে দেওয়া যাবে না। মানুষ হয়ে মানুষ কিংবা বাংলাদেশি হয়ে বাংলাদেশির পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই ভেবে খুব খারাপ লাগল। আরও খারাপ লাগল দূতাবাসের দরজায় দিনের পর দিন ধরনা দেওয়া একটি পরিবারের করুন অবস্থা দেখে। মানিকগঞ্জ থেকে ৪০ বছর বয়সে এক নারী তার স্বামীর সঙ্গে ভারতে এসেছেন আপন মামাকে একটি কিডনি দান করবেন বলে। দূতাবাস থেকে এ সংক্রান্ত একটি অনাপত্তি নেওয়ার আবশ্যিকতা রয়েছে। নারীটিকে দূতাবাস থেকে বলা হলো তার বাবার সম্মতি লাগবে। ১০ বছর বয়সে অর্থাৎ ৩০ বছর আগে বাবা মারা গেছেন বলে জানানো হলে দূতাবাস তার কাছ থেকে বাবার ডেথ সার্টিফিকেট দেখাতে বলে। ৩০ বছর আগে ডেট সার্টিফিকেট প্রথা মানিকগঞ্জের ওই গ্রামে প্রচলিত ছিল না। আর এখন ডেথ সার্টিফিকেট পেতে প্রয়োজন জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মসনদ। ৩০ বছর আগে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির জন্মসনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র কোথায় পাবে তারা? আর এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সবাই পলাতক, তখন কে, কার, কী সার্টিফিকেট দেবে? ১৮ বছর অতিক্রান্ত নারী কি নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখেন না? আইনি অভিভাবক হিসেবে স্বামী সঙ্গে থাকতে মৃত বাবার ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে কেন? কিন্তু না এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলল না।
আমি আমার কাঙ্ক্ষিত অনাপত্তিপত্রটি পাওয়ার জন্য দূতাবাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করলাম। আমাকে বলা হলো দুই ঘণ্টা দেরি হবে। আমি তাতেই রাজি হলাম এবং বসে থাকলাম। এরপর দূতাবাসের সর্বোচ্চ কর্তার সঙ্গে কথা বলে ও অনুরোধ করে হাতে পেলাম একটি অনাপত্তিপত্র। প্রতি শনিবার বেলা ১১টার মধ্যে সব কাগজপত্র জমা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশের আটক ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করতে ভিসা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও অনেক দর্শনার্থী দেখে অনুমান করা যায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশিই বন্দি আছেন এই জেলে।
কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে একই তথ্য পেলাম। আমার ডাক পড়ল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে। কাচের ওপারে থাকা মেয়েটির সঙ্গে টেলিফোনে ১০-১৫ মিনিট কথা বলার অনুমতি ছিল। কিন্তু মেয়েটি কেবলই কাঁদছিল। তেমন কিছুই বলতে পারছিল না। ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, বুকে সাহস রাখো, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। আমাদের একজন ডক্টর ইউনূস আছেন।
কলকাতায় যে কদিন ছিলাম প্রায় সর্বত্রই একই প্রশ্ন শুনেছি বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী? সেখানকার মানুষ নিরাপদ আছে কি? সবাইকে জোর গলায় বলেছি কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ এখন নিরাপদেই আছে এবং দেশ সঠিক পথেই এগিয়ে চলেছে। এ কথাগুলো যখন জনে জনে বোঝাচ্ছিলাম তখনই দেখলাম ওমানে থাকা আমার অতি প্রিয়জন এবং বিশিষ্ট সমাজসেবী ইয়াসিন চৌধুরীর চট্টগ্রামস্থ রাউজানের বাসভবনটি গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে একদল দুর্বৃত্ত। ব্যক্তিগতভাবে চিনি বলেই জোর গলায় বলতে পারি তার কাছ থেকে সাহায্য পায়নি এমন দরিদ্র পরিবার তার উপজেলায় সম্ভবত একটিও নেই। তিনি নিজেও একসময় একজন সাধারণ কর্মী হিসেবেই ওমানে এসেছিলেন এবং অহংকার করেই তিনি বলেন সম্পূর্ণ পরিশ্রম করেই তিনি আজ দেশের অন্যতম প্রবাসী সিআইপি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রবাসী সিআইপিদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের তিনি সাধারণ সম্পাদক। ওমানে বঙ্গবন্ধু পরিষদ এবং আওয়ামী লীগের শাখা-প্রশাখা থাকলেও তিনি সক্রিয় ছিলেন চট্টগ্রাম সমিতির সেবামূলক কাজ নিয়ে। এমন মানুষটির বাড়িঘর গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা সত্যিই মেনে নেওয়া কঠিন। আমাদের সামনে কি তবে আরও কঠিন সময় আসছে?
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email : [email protected]