১. বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বাঙালি জাতি শতাব্দী ধরে সংগ্রাম করেছে, তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর জাতি-রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। সংবিধান একটি রাষ্ট্রীয় দলিল। মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের দামে কেনা স্বপ্ন আকাক্সক্ষাগুলো সংবিধানে গ্রথিত।
২. কোনো সুবিশাল অট্টালিকা যেমন কয়েকটি শক্তিশালী স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, বাংলাদেশের সংবিধানেও কয়েকটি বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত আছে। রাষ্ট্র কীভাবে চলবে তা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে বলা হয়েছে, তেমনি সরকার যেন আগ্রাসী হয়ে জনগণের মৌলিক অধিকার গ্রাস করতে না পারে, তার গ্যারান্টিও দেওয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ পরস্পর সম্পর্কিত ও বিভক্ত এবং ভারসাম্যমূলক।
৩. গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো ভোটাধিকারের মাধ্যমে সরকার গঠন এবং পরিচালনার গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে শাসনক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত। আধুনিক গণতন্ত্রের অর্থ আরও ব্যাপক। গণতন্ত্র কেবল সরকার গঠন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার একটি পদ্ধতিই নয়, গণতন্ত্র নাগরিকদের জীবনযাপনের ধরন, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্মসূত্র। সেই ধারায় সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের অবসান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি এবং আদর্শ রূপায়ণের রূপরেখা স্পষ্টভাবে সংবিধানে দৃশ্যমান।
৪. বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র বলতে সব ধরনের সামাজিক বৈষম্যের অবসান, জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরিব, গ্রাম-শহরের সুযোগের সমতা, নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সমাজের সব সদস্যের সমমর্যাদার স্বীকৃতিকে বোঝায়। গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক চর্চা বিকাশ এবং ব্যক্তি ও সামাজিক গণতন্ত্রের প্রতি দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার এই সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদে বিধৃত রয়েছে।
ক. রাজনৈতিক গণতন্ত্র হলো জনসাধারণের ইচ্ছা ও সম্মতির মাধ্যমে পরিচালিত সরকার ব্যবস্থার মৌলিক দিক। জনগণ দেশের মালিক, তাদের সার্বভৌম ক্ষমতার স্বীকৃতি, অবাধ-সর্বজনীন ভোটাধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনসাধারণের কাছে সরকারের চূড়ান্ত দায়িত্বশীলতা, সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি প্রদান।
খ. অর্থনৈতিক গণতন্ত্র বলতে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সমভাবে অংশগ্রহণের অধিকার, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের অবসান, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং ন্যূনতম জীবনযাত্রার মানের নিশ্চয়তা বিধান। অর্থনৈতিক ন্যায়নীতি ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক গণতন্ত্র ফলপ্রসূ হতে পারে না। অর্থনৈতিক ন্যায়নীতি এবং জনগণের প্রাপ্যতা ও ন্যায্যতা গণতন্ত্রের প্রধান ভিত্তি। আর্থ-রাজনৈতিক ন্যায়নীতি রাষ্ট্রীয়ভাবে সমতা প্রতিষ্ঠা, শোষণের অবসান, ধন-বৈষম্যের বিলুপ্তি সাধন, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ন্যূনতম জীবনযাত্রার মানের নিশ্চয়তা বিধান, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা, বৃদ্ধ বয়সে অর্থনেতিক নিরাপত্তার স্বীকৃতি, দারিদ্র্যের অবসানসহ অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা সৃষ্টি করে।
জাতীয় আয় ও সম্পদের এককেন্দ্রিকতা প্রতিরোধ, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা, কাজের মানবিক পরিবেশ সৃষ্টি, অবসর বিনোদন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা অংশের জন্য অর্থনৈতিক প্রণোদনার ব্যবস্থা এবং নারী-পুরুষের সমতার নীতি। এসব মানবিক চাহিদা, আকাক্সক্ষা এবং মহৎ স্বপ্ন ’৭২ সনের সংবিধানে গ্রথিত।
৫. বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লিখিত অনুচ্ছেদ ও নীতিগুলো ধ্বংস বা দলীয়করণ করে যখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও একনায়কতন্ত্রের বৃত্তে বন্দি হয় তখন কর্তৃত্ববাদী শাসকের উদ্ভব হয়। বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের ভয়াবহ পরিণতি দৃশ্যমান হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের মূল যন্ত্র হলো পুলিশ, প্রশাসন এবং লুটেরা সিন্ডিকেট। তারাই হয়ে ওঠে শক্তিমান চক্র। দল, সরকার, সংসদ নেতৃত্ব যখন এক ব্যক্তির হাতে চলে যায়, তখন দানবীয় রাজত্ব কায়েম হয়। জনগণ উপেক্ষিত হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় এমন সব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয় যা নির্বাচিত সরকারকেও ফ্যাসিবাদী করে তোলে। যেমন, সচিবালয়ের ওপরে প্রধানমন্ত্রীর সুপার-সচিবালয়। প্রায় সব ফাইল টেনে আনা হয়। ছাড়পত্র পেতে হয়। স্বাক্ষর করতে হয়। প্রধানমন্ত্রীকে যদি সব ফাইল দেখতে হয় তাহলে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের দরকার কী? প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় যদি সুপার কেন্দ্র হয়, তাহলে সচিবালয় থাকার প্রয়োজন কোথায়? কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা দুর্নীতি ও দুঃশাসন ব্যবস্থার ভিত্তি। অথচ সংবিধানে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করার বিধান আছে যে, প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে নির্বাচন হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্থানীয় সরকার গঠন করে প্রতিটি স্তরে নেতৃত্ব দেবেন। প্রশাসন চালাবেন। কর আদায়, বাজেট ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন। তারা হবেন স্বশাসিত। বলতে গেলে এগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং উন্নত দেশের মতো প্রতিটি জেলায় হবে জেলা সরকার।
৬. কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘প্রাদেশিক সরকার গঠনের।’ বাংলাদেশ একটি একক স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র। মোট ভূখণ্ড প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইল। এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে প্রাদেশিক সরকার গঠন গ্রহণযোগ্য নয়। এ কথা মনে রাখতে হবে ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের সময় কুচবিহারে রংপুর ও দিনাজপুরের একাংশ একীভূত ছিল। তেমনি সিলেট আসামের অংশ ছিল, যা রেফারেন্ডামের মাধ্যমে এদেশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ, যারা প্রতিনিয়ত স্বায়ত্তশাসনের নেপথ্যে স্বশাসিত হওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ সমস্ত কিছু বিবেচনা করে প্রাদেশিক সরকার গঠন হবে রাষ্ট্রীয় সংহতি বিনষ্টের বীজ বপন করা। তেমনি আমলাতান্ত্রিক মাথাভারী প্রশাসনের দৌরাত্ম্য।
৭. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে আদৌ প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ ফেডারেল রাষ্ট্র নয়। একক সত্তা বিশিষ্ট রাষ্ট্র। তারপরও প্রশ্ন থাকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ কীভাবে গঠিত হবে? কীভাবে প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন? তারা কারা? সমাজের জ্ঞানী-গুণী অথবা সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ উচ্চকক্ষে থাকবেন, সেক্ষেত্রে তারা কোন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় উচ্চ কক্ষে নির্বাচিত হবেন তা পরিষ্কার করে কেউ বলেননি। যারা উচ্চ কক্ষের কথা বলছেন, বিষয়টি তাদের পরিষ্কার করা দরকার। ভারতে কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ গ্রেট ব্রিটেনের সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্য ও পদ্ধতি অনুসরণে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন করেছেন। ফেডারেল রাষ্ট্রে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা থাকতে পারে। ভারতীয় দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অর্থাৎ উচ্চতর কক্ষ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত। ২৫০ জন সদস্য সমন্বয়ে রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা, সংগীত, সমাজসেবা ইত্যাদির ক্ষেত্রে যারা বিশেষ অবদানের পরিচয় রেখেছেন তাদের মধ্য থেকে অনধিক ১২ জনকে মনোনীত করতে পারেন। ভারতে উচ্চকক্ষের উপযোগিতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল এবং আরও জোরদার হয়েছে। বিভিন্ন বিধানসভা থেকে আগত প্রতিনিধিরা মূলত রাজনৈতিক দলের সমর্থক বা মতাদর্শের বিশ্বাসী। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি মনোনীত মাত্র ১২ জন সদস্যের কিছুই করার থাকে না। ভারতে উচ্চকক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যয়বহুল একটি কক্ষ মাত্র। যা বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে হবে শ্বেতহস্তী, যা লালন-পালন করার অর্থনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের নেই।
৮. ‘প্রাদেশিক সরকার ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ’ করতে গেলে প্রয়োজন হবে নতুনভাবে নতুন সংবিধান। এর জন্য অপরিহার্য হবে গণপরিষদ গঠন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন করে সংবিধান লিখতে গেলে গণপরিষদ গঠন এবং তার মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়ন একটি জটিল, দুরূহ ও সময়ক্ষেপণের বিষয়। বাংলাদেশে বর্তমানে সংসদ নেই। গণপরিষদ গঠন করতে গেলে জনগণের কাছ থেকে ভোটের মাধ্যমে ম্যান্ডেট নিতে হবে। সে বাস্তবতা দেশে বিরাজ করছে না। যেসব অনুচ্ছেদ পরিবর্তন, পরিমার্জন করা জরুরি সেগুলো সংবিধান সংশোধন করে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী বিন্যস্ত করা সম্ভব। সংবিধান পুনর্লেখন বর্তমান ক্রান্তিকালীন সময়ে অযৌক্তিক, বরং যথাযথ কার্যকর সংশোধন বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়াও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী ও নিরপেক্ষকরণ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, ৭০ অনুচ্ছেদ, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আধুনিকীকরণের পাশাপাশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার অপরিহার্য সংশোধন জরুরিভাবে করা সম্ভব।
লেখক : ’৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী, লেখক ও গবেষক