মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো শয়তান। সে কর্ম থেকে কখনো অবসর নেয় না। যে বান্দা আত্মিক শক্তিতে যত প্রবল তার জন্য তত প্রবল বুদ্ধিসম্পন্ন শয়তান সদস্য নিয়োগ করা হয়। আল্লাহপাক শয়তানের সব কার্যক্রম আমাদের জানিয়ে দিয়ে তার খপ্পর থেকে বেঁচে থাকার পদ্ধতিও বাতলে দিয়েছেন। তথাপি বারবার আমরা তার খপ্পরে পড়ে যাই, তার প্ররোচনার জালে আটকা পড়ি। অর্থাৎ আল্লাহর নাফরমানি করি। কিন্তু তারপরও মেহেরবান আল্লাহ আমাদের পর করে দেন না। বান্দা গুনাহ করার পরও কীভাবে আল্লাহর আপন থাকতে পারবে তার তরিকা তিনি শিখিয়েছেন এভাবে- ‘তোমরা নিজেদের গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।’ অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে (কখনো) নিরাশ হইও না। (কারণ) নিশ্চয়ই আল্লাহপাক (তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করলে তোমাদের) সব ধরনের গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ ইস্তেগফার শব্দের অর্থ হলো ক্ষমা প্রার্থনা করা। দুনিয়াতে সন্তান যত বড় অপরাধই করুক, পিতা-মাতার কাছে যদি আকুতি-মিনতি করে ক্ষমা চায়, তাহলে তারা কি ক্ষমা না করে পারেন? পারেন না। কারণ সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার যে মায়া, বান্দার প্রতি আল্লাহর মায়া তার চেয়ে অনেক বেশি। যা হোক গুনাহ করার পরও আমরা আল্লাহর আপনত্ব ধরে রাখব? ইস্তেগফারের মাধ্যমে। যত বেশি ইস্তেগফার করব তত বেশি আপন হব। জানা-অজানা, ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, ছোট-বড় কত গুনাহ যে আমরা করি তার কোনো হিসাব নেই। অতএব প্রতিদিন বহুবার ইস্তেগফার করা দরকার। এমনকি হাঁটতে-চলতে সব সময় পড়তে পারি। অন্তত ন্যূনতম কোনো কষ্ট হয় না। এতটুকু পড়তে তো মনে রাখতে হবে যে, আমার প্রতিটি কাজকর্মের হিসাবের জন্য হাশরের ময়দানে আল্লাহর আদালতে আমাকে দাঁড়াতে হবে। দুনিয়ার আদালতে যে বিচার হয়, সেখানে কী বিষয়ের আলোচনা হয়? দোষী সাব্যস্ত হোক বা না হোক পত্র-পত্রিকায় প্রথমে আসে গ্রেপ্তারের কথা। এরপর আদালতে হাজির হতে হয়, উকিলরা জেরা করেন। মানুষ তা শোনে। শরিয়তে এটা নিষেধ নয়। কেননা কোনো মজলুম তার ন্যায্য হক আদায়ের জন্য সর্বশেষ চেষ্টা করবে আদালতের মাধ্যমে। শরিয়ত বলে, অন্যের গিবত তথা দোষচর্চা করো না, তাহলে তোমার দোষচর্চা করা হবে। তবে নিজের হক আদায়ের জন্য অন্যের দোষ বলা যায় যদি বিশ্বাস হয় যে, তৃতীয় ব্যক্তির কাছে বললে সে আমার হক আদায় করে দিতে পারবে এবং জালিমকে জুলুম করা থেকে ঠেকাবে। তৃতীয় ব্যক্তি সমাজের যে কেউ হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে সেরা জায়গা হলো আদালত। যদি কারও নাম নিয়ে তার দোষের কথা বিচারকের কাছে বলে তাহলে একে আদৌ গিবত বলা হবে না। তবে মিথ্যা বলতে পারবে না। নিজে মিথ্যা বলবে না, উকিলকেও মিথ্যা বলাবে না। কারণ হাদিসে আছে, তোমার মিথ্যা ওকালতি তোমাকে ধ্বংসের মধ্যে নিয়ে যাবে, দুনিয়াতেও, আখেরাতেও। হাদিসের মধ্যে আছে, ‘তুমি তোমার সাথি-সঙ্গী, বন্ধুবান্ধব ও মুসলমানদের প্রতি নম্র-ভদ্র ও ন্যায়পরায়ণ হও, এমনকি মজলুম ও জালিমের সাহায্যে এগিয়ে আসো।’ এক সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ মজলুমকে সাহায্য করার বিষয়টা তো সহজে বোধগম্য কিন্তু জালিমকে কীভাবে সাহায্য করব? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জালিমকে সাহায্য করার অর্থ হলো তাকে জুলুম করা থেকে বিরত রাখা। মানুষ অভাবগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির সাহায্য করার বিষয়টি বোঝে, কিন্তু লুটেরা, সন্ত্রাসী, অত্যাচারীকে সাহায্য করাটা বোঝে না। এ জন্যই হজরত আলী (রা.) বলেছেন, মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত যুক্তি অনুপাতে যদি শরিয়তের বিধান সাজানো হতো তাহলে মোজা মাসেহ করার নিয়ম পায়ের নিচ দিয়ে হতো, ওপর দিয়ে নয়। কেননা যুক্তি তো হলো ময়লা লাগে পায়ের নিচে, তাই মাসেহ করলে পায়ের নিচে কিংবা ওপর-নিচে সবখানে করা হবে। অথচ নবী (আ.) বলেছেন, তোমরা মোজার শুধু ওপরে মাসেহ করো, নিচে নয়। যুক্তি যতই বলুক পায়ের নিচ দিয়ে মোজা মাসেহ করতে, করা যাবে না। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওপর দিয়ে মাসেহ করতে বলেছেন। এটা ময়লা দূর করার জন্য করা হচ্ছে না। বরং শরিয়তের একটি নির্দেশ পালন করার জন্য করা হচ্ছে। এই নির্দেশ পালনে এই ফায়দা হবে যে, মোজা খুলে পূর্ণ পা ধুলে যে সওয়াব পাওয়া যেত এখানেও তা পাওয়া যাবে। তাই উদ্দেশ্য ঠিক করে নিতে হবে যে, মোজার ওপর মাসেহ করছি শরিয়তের হুকুম পালনের জন্য, ময়লা দূর করার জন্য নয়। এ জন্যই তো নামাজ চার রাকাত, তিন রাকাত, দুই রাকাত পড়া হয়। রহস্য কী? অনেকে বিভিন্ন উত্তর দেন। কিন্তু মূল রহস্য হলো শরিয়তের নির্দেশ। তাই যুক্তিতে বুঝে আসুক বা না আসুক বান্দার দায়িত্ব মনিবের হুকুম পালন করা। মজলুমকে সাহায্য করা সবাই বোঝে কিন্তু জালিমকে সাহায্য করার বিষয় অনেকে বোঝে না। সাহাবির প্রশ্নের উত্তরে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জালেমকে সাহায্য করা হলো তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখা; যেভাবেই হোক। কারণ জুলুমের কারণে দুনিয়াতে শাস্তি পাবে আখেরাতেও শাস্তি পাবে। এভাবে সে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে হয়তো দুনিয়াতে শরিয়তসম্মত শাস্তি পাওয়ার কারণে আখেরাতের শাস্তিটা আল্লাহতায়ালা মেহেরবানি করে কমিয়ে দিতে পারেন বা ক্ষমা করে দিতে পারেন। জালিমকে যদি জুলুম থেকে রক্ষা করা যায়, তাহলে এটা তার জন্য বড় উপকার করা হবে। চাই সে বুঝুক বা না বুঝুক! ছোট বাচ্চা আগুন দেখলে ধরতে যায়, মা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। আবার ধরতে যায়, আবার মা ফিরিয়ে এনে আগুন থেকে রক্ষা করেন। বাচ্চা হয়তো তখন কান্না করে। কিন্তু মা তার কান্না দেখে দমে যান না। কারণ এখানে তার ক্ষতির প্রশ্ন। এখানে মায়া দেখালে হবে না। তদ্রুপ জালিমের ক্ষেত্রে এ আচরণ করতে হবে।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ