অন্তত ৫ হাজার বছর ধরে ফিলিস্তিনে ফিলিস্তিনিদের বসবাস। যুগে যুগে এ পুণ্যভূমিতে প্রেরিত হয়েছেন বহু নবী-রসুল। তাঁদের সমাধিস্থলও এর আশপাশেই অবস্থিত। গাজা ফিলিস্তিনের একটি বিশিষ্ট অঞ্চল। গাজা থেকে মাত্র দুই মাইল উত্তরে কিবুটস নামক এলাকা। ত্রিশ দশকের কথা। পোল্যান্ড থেকে এসে কয়েকটি ইহুদি পরিবার কিবুটস এলাকায় বসবাস শুরু করে এবং ওই এলাকায় তারা কৃষি খামার গড়ে তোলে। ফিলিস্তিনিরা তখন কৃষিকাজে অভ্যস্ত ছিল। তাই পরস্পর মিলেমিশে কৃষিকাজের মাধ্যমে উভয় জাতি বসবাস করতে শুরু করে। ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলছিল। সরল ফিলিস্তিনিরাও নির্দ্বিধায় তাদের স্থান দেয়। কিন্তু শিগগিরই ত্রিশের দশকেই ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারল যে তারা ধীরে ধীরে নিজেদের জমি হারাচ্ছে। এরই মধ্যে ইহুদিরা দলে দলে সেখানে আসতে থাকে এবং জমি ক্রয় করে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। মূলত ইউরোপীয়দের একটি দুরভিসন্ধি ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইন্ধন জোগাচ্ছিল। ইউরোপীয়রা ইহুদিদের তাদের আশপাশে থাকা কোনোভাবেই পছন্দ করত না। তাই তারা মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইহুদি উপনিবেশ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিল। ইউরোপে ইহুদিদের প্রতি যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সেটি তাদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের ভাবনাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। ফলে জাহাজে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে আসতে থাকে। বিশেষ করে ১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়। বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসে একত্র হতে থাকে। তখন ফিলিস্তিনি আরবরা ভালোভাবেই বুঝতে পারে যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে।
১৯১৭ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের কর্তৃত্ব ছিল তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্কের সেনাদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন। তখন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য তারা সহায়তা করবে।
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখন্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি ফিলিস্তিনিদের জন্য। আর জেরুজালেম থাকবে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে। জাতিসংঘ বিভিন্নভাবে অন্যায় করেছে। ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদিদের ভাগ দিয়েছে। ইহুদিরা মোট ভূখন্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেওয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের রাজধানী তাদের না দিয়ে সংঘাত চালু রাখার ষড়যন্ত্র করেছে। তাই ফিলিস্তিনিরা স্বভাবতই জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের ভূখন্ডে ইহুদিরা স্বাধীন ভূখন্ডের ঘোষণা পেয়ে তারা বিজয় উল্লাস করে। তখন থেকেই ইহুদিদের সশস্ত্র দলগুলো প্রকাশ্যে আসা শুরু করে। আর ফিলিস্তিনি মুসলমানরা পদে পদে নিজ ভূমিতেই নির্যাতিত সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। একই দিন তৎকালীন ইহুদি নেতারা ঘোষণা করেন যে সেদিন রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হবে। শুরু হলো ফিলিস্তিনিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন, বর্বর পাশবিক হামলা। নিজেদের ভূখন্ডে দখলদার ইহুদিদের হাতে প্রতিনিয়ত তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ইসরায়েলের চলমান প্রেক্ষাপটে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নারী, শিশু ও অসহায় মানুষ হতাহতের কোনো গণনাই নেই। মানবতা সেখানে বিপন্ন হচ্ছে পদে পদে। নিজেদের ভূমিতে নিজেদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে চরমভাবে। ইসরায়েল প্রতিদিন তাদের দুরভিসন্ধি ও ভয়াবহ ষড়যন্ত্র নিয়ে এগোচ্ছে। ফিলিস্তিনে তাদের তান্ডবে সাম্প্রতিককালে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অধিকাংশ নারী, শিশু, বয়স্ক ও অসহায় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ। ইতোমধ্যে ইসরায়েলি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক তান্ডব লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চল গ্রাস করে নিয়েছে। অব্যাহত আছে তাদের স্থল ও আকাশপথে বহুমুখী আক্রমণ। তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ফিলিস্তিন নামক এ দেশটিকে বিশে^র মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে ফেলা। গোটা বিশে^র মানবতাকর্মীদের তেমন কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে একমাত্র ইরান ব্যতীত অন্য কোনো দেশের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। বরং জর্ডানের মতো একটি মুসলিম দেশ সক্রিয়ভাবে হিংস্র ইহুদিদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এই কঠিন মুহূর্তে সমগ্র বিশে^র মানবতাকামী জনগণ সর্বশক্তি নিয়ে ইহুদিদের এই অমানবিক তান্ডব রুখে দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হওয়া সময়ের একান্ত দাবি। বিশেষ করে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে সব মুসলমানের এক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এহেন দুরভিসন্ধিক্ষণে যদি মুসলিম বিশ^ ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ এড়িয়ে যায়, তাহলে অচিরেই মুসলমানদের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে হবে। অবিলম্বে ইসরায়েলি এই তান্ডব ছড়িয়ে পড়বে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। অতএব বর্তমানে ফিলিস্তিন স্বাধীনতাকামীদের সার্বিক সহযোগিতায় আমাদের আপন আপন সাধ্যমতো এগিয়ে আসার শপথ নিতে হবে।
♦ লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা