রাজনীতিতে দ্বৈতনীতির চর্চা দেশের জন্য যেমন মঙ্গল বয়ে আনে না, তেমনি দলের জন্যও কল্যাণকর কিছু হতে পারে না। আর নেতা বা ব্যক্তির ভবিষ্যৎও সুখকর হয় না। সার্বিক পরিণতিও হয় ভয়াবহ। দেশে-বিদেশে এমন উদাহরণ অনেক থাকলেও সেখান থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। এটাই যেন ইতিহাসের নিয়ম। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। ওই বছরই ৩০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে নিহত হওয়ার পর ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ড. কামাল হোসেনকে প্রার্থী করে। নির্বাচনে বিএনপির বিচারপতি আবদুস সাত্তার জয়ী হন। মাত্র চার মাস নয় দিন পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমে ঘরোয়া রাজনীতি এবং পরে প্রকাশ্য রাজনীতির অনুমতি দিলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদ ও জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এরশাদকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ১৯৮৬ সালের ৭ মে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা আসে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না জানিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে। তবে শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ এরশাদের সঙ্গে হাত মেলায় এবং নির্বাচনে অংশ নেয়। জামায়াতে ইসলামীও থাকে নির্বাচনে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে শাসক দল জাতীয় পার্টিই সরকার গঠন করে।
তবে দেশব্যাপী এরশাদবিরোধী আন্দোলন বেগবান হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতসহ বড় দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে এবং ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচনে বিএনপির জয়ের পরই সরকারকে নব্য স্বৈরাচার আখ্যা দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে আওয়ামী লীগ। সরকারবিরোধী আন্দোলন তেমন বেগবান না হলেও ১৯৯২ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা ২৬ মার্চ গণ আদালত নাম দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশে বিপুল লোক সমাগম ঘটায়। এ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখনই সরকার পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবিতে আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সঙ্গী করে নেয় জামায়াতে ইসলামীকে। ১৯৯৪ সালের ২৭ জুন সংসদ ভবনে জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল মতিউর রহমান নিজামীকে নিয়েও বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। স্বৈরাচার এরশাদকেও ‘গণতন্ত্রের বন্ধু’ আখ্যা দিয়ে জাতীয় পার্টিকে জোটবদ্ধ করা হয় আন্দোলনে। তখন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত নেতারা নিয়মিত বৈঠক করে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করতেন। একপর্যায়ে এই তিন দলের ১৪৬ জন সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করেন। এ পদত্যাগ বৈধ কি না তা সুরাহার জন্য বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালত সদস্য পদ বাতিল বলে সিদ্ধান্ত দিলে স্পিকার তাদের সদস্য পদ বাতিল করে দেন। পরে সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী ওই নির্বাচন বর্জন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করে। সেই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর ২৫ মার্চ রাতে সংসদ অধিবেশনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এ সংশোধনীও মেনে নেয়নি এবং জাতীয় পার্টি ও জামায়াতকে নিয়ে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যায়। ৩০ মার্চ সরকার পদত্যাগ করলে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মেনে না নিলেও সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে হাজির হন শেখ হাসিনা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের জন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি হিজাব পরে হাতে তজবি নিয়ে নির্বাচনি জনসভায় অংশ নেন এবং অতীতে কোনো ভুল হয়ে থাকলে তার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে একবার দেশ সেবার সুযোগ চান। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরই শেখ হাসিনা তজবি ও হিজাব ছেড়ে দেন এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করেন জাতীয় পার্টি ও জাসদকে সঙ্গী করে দুটি মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগ লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে পদত্যাগ করলে ১ অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠনকালে জামায়াতের দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মন্ত্রী করে।
২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষে ২৮ অক্টোবর পদত্যাগ করে সরকার। তার আগেই শেখ হাসিনা দলীয় নেতা-কর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে মাঠে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন সরকারের পদত্যাগের দিন। সরকার পদত্যাগের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মনমতো না হওয়ায় আওয়ামী লীগ আন্দোলন, ভাঙচুর চালিয়ে যেতে থাকে। ওই দিন থেকে এক মাসের সংঘাতে ৪০ জন নিহত হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিবর্তন করেও আন্দোলন থামানো যায়নি।
এ পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ফখরুদ্দীন আহমদ ক্ষমতায় আসেন। পেছন থেকে সমর্থন দেন সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ। ওয়ান- ইলেভেন নামে পরিচিত ওই সরকারকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাদের ‘আন্দোলনের ফসল’ আখ্যা দিয়ে তাদের সব কর্মকান্ডকে বৈধতা দেওয়ার ঘোষণা দেন।
ওই সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ওয়ান- ইলেভেন সরকারের কর্মকান্ডকে বৈধতা দিলেও দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ নেতারা বলতে থাকেন, ওয়ান-ইলেভেন নামক তত্ত্বাবধায়ক সরকার জগদ্দল পাথরের মতো জাতির কাঁধে চেপে বসেছিল। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর আসতে দেওয়া হবে না। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এত আন্দোলন এত রক্তপাত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয় সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।
এরই মধ্যে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা। মামলায় জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, এম কামারুজ্জামান ও মীর কাশেম আলী এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসি দেওয়া হয়। জামায়াতের প্রবীণ নেতা অধ্যাপক গোলাম আজম ও মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে প্রথমে মৃত্যুদন্ড ও পরে দেওয়া হয় আমৃত্যু কারাদন্ড।
প্রথম মামলার রায়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হলে তার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বাধীন গণজাগরণ মঞ্চকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে টেবিল চাপড়িয়ে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দেন। সরকারিভাবে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা পায় গণজাগরণ মঞ্চ। আইন সংশোধন করে ফাঁসিও দেওয়া হয় আবদুল কাদের মোল্লাকে। সেই ইমরান এইচ সরকার পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে প্রয়োজনীয়তা হারান এবং ছাত্রলীগের পিটুনির শিকার হন।
গণজাগরণ মঞ্চে ইসলামবিরোধী বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ এনে হেফাজতে ইসলাম মাঠে নামে। তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করলে তা দমন করে পুলিশ। ২০১৩ সালের ৫ মে দিনব্যাপী ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন পর্যায়ে শাপলা চত্বরে সমবেত হন হেফাজতের নেতা-কর্মীরা। মধ্যরাতের পর পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ নামে এক ঘটনার পর অভিযানে সমাবেশ পন্ড হয়ে যায়। হেফাজতের কর্মকান্ড থেমে যায়। কালক্রমে হেফাজতে ইসলামের আমির মাওলানা শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে রফা করেন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাওলানা শফীর সভাপতিত্বে এক শোকরানা মাহফিলে শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেয় হেফাজত। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে শেখ হাসিনা ভূয়সী প্রশংসা করেন মাওলানা শফীর। স্বৈরাচার থেকে শুরু করে জামায়াত কিংবা হেফাজতে ইসলামসহ বহু সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কখনো বন্ধুত্ব আবার কখনো বৈরী সম্পর্ক তৈরি করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে দীর্ঘদিন নানা খেলা খেলেছে এ দলটি। গত ১ আগস্ট এক নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু ততদিনে সরকারের আয়ু যে শেষ হয়ে গেছে টের পাননি স্বয়ং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। মাত্র চার দিন পরই গণজোয়ারে ভেসে যায় সরকার। কখনো বৈরিতা কখনো বন্ধুত্ব- এ দ্বৈত নীতি যারা প্রয়োগ করে তাদের কাছে ‘সুফলদায়ক’ মনে হলেও ওটা জাতির জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। পরিণাম যে ভয়াবহ হয় তার প্রমাণ ‘৩৬শে জুলাই’ বা ৫ আগস্ট।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক