শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এ বছর শারদীয় দুর্গোৎসব পালিত হয়েছে। দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাই ও বোনদের বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা। বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আমরা বিশ্বাস করি, ধর্ম যার যার দেশ সবার। দেশের নাগরিক হিসেবে যে কোনো মানুষ তার নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। একইভাবে তারা ভোগ করবেন ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। বিগত সরকারের আমলে এক অদ্ভুত তত্ত্ব হাজির করা হয়েছিল। বলা হতো ধর্ম যার যার উৎসব সবার। শুনতে ভালো লাগলেও এ তত্ত্ব বিভেদের উসকানি দিয়েছে। দুনিয়ার সব সভ্য সমাজে নানা ধর্মের মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়। এটি গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। তবে ধর্মীয় উৎসব সবার হতে পারে না খুব সংগত কারণেই। যারা মূর্তি পূজার বিরোধী তারা পূজার উৎসবে অংশ নেবেন, তা আশা করা যায় না। এ ধরনের প্রত্যাশা বরং অস্বস্তি বাড়ায়। মুসলমানদের ঈদুল আজহায় কোনো সনাতন ধর্মাবলম্বীর অংশগ্রহণ স্বস্তিদায়ক বলে বিবেচিত হয় না। এমন তত্ত্ব বরং বিভেদ সৃষ্টিতে মদত জোগায়।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় বাংলাদেশি করেছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে। বাংলাদেশের ৯৯ ভাগ মানুষ বাঙালি হলেও তিনি শতকরা এক ভাগ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কথা ভুলে যাননি। বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্ম সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে আসছে যুগ যুগ ধরে। এ সহাবস্থান আমাদের জাতীয় ঐক্যকে দৃঢ় করেছে। শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে পূজামন্ডপের নিরাপত্তা রক্ষায় সব সম্প্রদায়ের লোক সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সহযোগিতা করেছে। তবে আমি মনে করি, দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া দরকার যেখানে মসজিদ-মন্দির, গির্জা-প্যাগোডার নিরাপত্তা রক্ষায় কাউকে ভাবতে হবে না। দেশে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু কোনো বিভাজন থাকবে না। সব ধর্মের অধিকার রক্ষায় রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো একসঙ্গে কাজ করবে।
এ বছর শারদীয় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে সম্প্রীতি রক্ষার অভিন্ন অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছিলেন বিভিন্ন ধর্মের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। জুলাই বিপ্লবের পর কয়েকদিন সুযোগসন্ধানীরা অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চেয়েছিল। জুলাই বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কারণ জুলাই বিপ্লবে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল। যেমন জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে সচেতন ছাত্র-জনতা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি-মন্দিরে পাহারা বসিয়েছে। এমনকি মাদরাসার ছাত্ররা রাত জেগে মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের দুরভিসন্ধি ঠেকাতে প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করেছে। জুলাই বিপ্লবের সেøাগান ছিল দেশটা কারোর বাপের নয় ১৮ কোটি মানুষের। এটি নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। সরকারকেও যে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে যত্নবান হতে হবে। বিশেষ করে গণতন্ত্রচর্চায় সমঝোতা ও সংযমের পথ বেছে নিতে হবে আমাদের সবাইকে। দেশে গণতন্ত্র থাকলে দল-মত-ধর্ম-নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার রক্ষায় তা যথেষ্ট। গণতান্ত্রিক সমাজে একটা মানুষও যদি ভিন্ন মতাবলম্বী থাকে তার অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তার বিশ্বাসকে মূল্য দেওয়া হয়। গণতন্ত্রে নাগরিকদের মনুষ্য পরিচয় সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পায়। গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরু হলেই যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার থাকে না।
গত বুধবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পূজামন্ডপ পরিদর্শনকালে বলেছেন, পরিবর্তনের সুযোগ সবাইকে নিতে হবে। এ দেশটা কারও একার নয়। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক একটা রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণ। সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে, দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেছেন, শারদীয় দুর্গাপূজা আপনাদের জীবনে অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসুক, একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করুক, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক। আমরা ভয়াবহ দানবীয় শক্তিকে পরাজিত করেছি। আমাদের একটা নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যেখানে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না ধর্মান্ধতা থাকবে না সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা বা ঘৃণার কোনো রাজনীতি থাকবে না। অতীতে যেমন বিএনপি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ঠিক একইভাবে আগামীতেও থাকব। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, একটি রাজনৈতিক দল বরাবরই বলে তারাই নাকি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ত্রাণকর্তা। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের যত জমিজমা, সম্পত্তি দখল করে নেওয়া হয়েছে তার মূলেও তারা ছিল। এটি নিছক অভিযোগ নয়। কেউ যদি তদন্ত করে দেখেন, তবে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। ভবিষ্যতে জনগণের ভোটে যে সরকার নির্বাচিত হবে তারা এ বিষয়ে তদন্তের আয়োজন করতে পারে। কোথায় কারা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জায়গা জমি এমনকি মন্দির দখল করেছে তা তদন্ত করে তাদের হাতে ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এটি করা হলে তা একটি মহৎ কাজ বলে বিবেচিত হবে।
সবারই জানা, প্রায় ১৬ বছর ধরে ফ্যাসিবাদী শাসন চেপে বসেছিল এ দেশের মানুষের ঘাড়ে। জুলাই বিপ্লব ফ্যাসিবাদী দৈত্যের কবল থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে দেশের মানুষ ভোটাধিকার বঞ্চিত। কাজেই গণতন্ত্র বা নির্বাচিত সরকার কবে প্রতিষ্ঠিত হবে তা ১৮ কোটি মানুষের আগ্রহের বিষয়। জুলাই বিপ্লবের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের লক্ষ্য দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়া। তবে তার আগে দেশের যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে এগুলো সচল করা তাদের কর্তব্য। এজন্য তারা সংস্কার শুরু করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো চায় এ সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন হোক। যত সম্ভব কম সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হোক। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হোক এটিও ১৮ কোটি মানুষের দাবি। এ দাবিকে সামনে রেখে গত ৬ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সংলাপে দুই পক্ষের আস্থার সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে বলে আমার মতো অনেকেরই বিশ্বাস। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। জনগণের আস্থা ধরে রাখার জন্যই সম্ভাব্য কম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংস্কার শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়া হবে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভাষ্য, নির্বাচনই তাদের এক নম্বর অগ্রাধিকার। তবে নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে তারা সরকারের কাছে কোনো মাস বা দিন-কালের কথা বলেননি। বিএনপি ১৮টি দাবি সামনে রেখে কথা বলেছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কার চেয়েছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি। দেশে প্রতিটি ক্ষেত্রে যে সমস্যার পাহাড় গড়ে উঠেছে, তার সমাধানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হওয়া দরকার। জনগণের মনের ভাষা পড়ার ক্ষমতা একমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোরই থাকে। এ সত্যটি কখনোই ভুলে যাওয়া চলবে না।
বিএনপির পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছে জামায়াতে ইসলামী। আলোচনায় জামায়াত নেতারা যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। উভয় দলের ভাষ্য, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হোক তা তারা চান না। সেজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। অভিন্ন বক্তব্য এসেছে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দলের পক্ষ থেকে।
দ্রুত নির্বাচন না দিলে অথবা সংস্কারে দীর্ঘ সময় লাগলে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ অস্থির হয়ে উঠতে পারে। ভিন্ন পরিস্থিতির আশঙ্কা তৈরি হবে। কমিউনিস্ট পার্টি ও বাম জোটের নেতাদের ভাষ্য, নির্বাচিত সরকার ছাড়া সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাবে না। এজন্য নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এখনই আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে জুলাই বিপ্লবের ফসল হিসেবে। তবে এ সরকার নির্বাচিত সরকার নয়। সরকারের যারা কর্ণধার তারা সুযোগ্য এবং সজ্জন সন্দেহ নেই। তবে তারা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন না।
রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন তাদের যাত্রাপথকে মৃসণ করতে সাহায্য করবে। অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার এবং নির্বাচন দুটিই সম্ভাব্য কম সময়ে সম্পন্ন করতে চায় তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে নিশ্চিত হয়েছে। শহীদ জিয়া একদলীয় পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করে দেশে বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পেলে বিএনপি সাচ্চা গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জুলাই গণ অভ্যুত্থান জনগণকে যে স্বাধীনতা দিয়েছে তা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করা হবে।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক