দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ ও স্বল্প আয়ের মানুষ বিপর্যস্ত। চলমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের নিত্যদিনের চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম মেটাতে ভোক্তার হাঁসফাঁস অবস্থা। আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের পেছনে। খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যের বিরূপ প্রভাব পড়েছে অতিদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। অনেক দিন ধরে নিত্যপণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তারা আয়ের সঙ্গে ব্যয় সংকুলান করতে পারছে না। খরচ কমিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। যা আয় করে, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত কষ্টে তারা জীবনযাপন করছে।
নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি পতিত স্বৈরাচার সরকারের সময় থেকেই শুরু হয়েছে। সে সময় ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। মানুষের কষ্টেরও লাঘব হয়নি। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী একশ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। পতিত স্বৈরাচার সরকার তা জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় এখানকার বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী মধ্যম আয়ের। সেখানে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের নাভিশ্বাস। সরকার ইতোমধ্যে বাজারে স্বস্তি আনতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সেগুলো বাস্তবায়ন যেন দুর্নীতিমুক্তভাবে ঘটে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত। নীতি-নৈতিকতা, জবাবদিহি ও জনসেবামূলক ভূমিকা দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম বেশি। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য জিনিসপত্রের দাম এতটাই বেড়ে গেছে যে, তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন বলে মনে হচ্ছে। তারা গরুর মাংস কিনতে পারছে না, ইলিশ মাছ তো দূরের কথা! এমনকি দাম বেশি হওয়ায় তারা ভালো মানের সবজিও কিনতে পারছে না।
বাজার সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকছে না। কখনো ডিম, কখনো পিঁয়াজ, আলু, সবজি কিংবা কখনো মাছ-মুরগির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি গরিব, নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনকে রীতিমতো দুর্বিষহ করে তুলছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারেও আজ নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু বাজারে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে একেকটি নিত্যপণ্যের দাম। সব শ্রেণি-পেশার মানুষই নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশাহারা। কোনো কোনো পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। উৎপাদনের উৎস থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত অনেক স্তর রয়েছে। উৎপাদনকারী ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। অথচ ভোক্তাকে অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এর মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগী একটি চক্র সক্রিয়। এ ছাড়া বিপণন ব্যবস্থা দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত থাকায় সাধারণ মানুষ কষ্ট ভোগ করছে। পুরো বিপণন ব্যবস্থার মধ্যে যে অব্যবস্থাপনা রয়েছে তা সরকারকে দূর করতে হবে। বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মোটেই সংগঠিত নয়। এর সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এখন বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের জীবনে বেশ চাপ সৃষ্টি করছে। দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম না কমা দুশ্চিন্তার কারণ দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারের যেসব বিভাগ ও সংস্থা রয়েছে, তাদের কার্যক্রম নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যেন বাজারকে অস্থির করতে না পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। আমদানি ঠিক রেখে সাপ্লাই চেইন সচল রাখার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অন্তর্র্বর্তী সরকার শুল্কছাড় ও আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়ার মতো কিছু সুবিধা দিলেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। কঠোরভাবে বাজার মনিটরিংয়ে প্রতি জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের সীমিত জনবল নিয়ে বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে, কিন্তু এ অভিযানেরও বাজারে কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বর্তী সরকার পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ধ্বংস করে যাওয়া অর্থনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ব্যাংক ও আর্থিক খাতসমূহে সুশাসন ফিরিয়ে আনার সংস্কারের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভালো। স্বৈরাচার সরকারের সময় চাল, ডাল, শাকসবজি, পিঁয়াজ, রসুন, মাছ, গোশত, ডিম, ব্রয়লার মুরগিসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের নেতা-কর্মী ও পুলিশ ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি করত। এখন তা থেকে মুক্ত। অন্তর্র্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। ডিজেল, পেট্রলসহ জ্বালানি তেলের দাম কমিয়েছে। তারপরও দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়া অস্বাভাবিক। এখানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় রয়েছে। তারা যে নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।
আমি মনে করি, এখন ব্যবসায়ীদের উচিত, দ্রব্যমূল্য কমাতে তাদের উদ্যোগী হওয়া। দেশ ও সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা। তাদের মধ্যে কারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত, তা তারা ভালো করেই জানেন। এদের নিবৃত্ত করাও তাদের দায়িত্ব। তাদের মনে রাখতে হবে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে, তা এগিয়ে নিতে তাদের পুরনো মানসিকতা বদলাতে হবে। মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসা নয়, বরং সৎ, মানবিকতা ও দেশের সেবার মানসিকতা নিয়ে নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে।
ছাত্র-জনতা সমর্থিত অন্তর্র্বর্তী সরকারের উচিত, সাধারণ মানুষের নিত্যকার যেসব সমস্যা, তা নিরসনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মুটে-মজুরসহ সবশ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ও জীবন দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল, স্বৈরাচারী সরকারের কাছে তাদের জীবনজীবিকা উপেক্ষিত থাকা। কোনো দিক দিয়েই তাদের স্বস্তিতে রাখেনি। সাধারণ মানুষের চাওয়া, তারা যাতে উপার্জিত আয়ের মধ্য থেকে জীবিকানির্বাহ করতে পারে। সে সুবিধা স্বৈরাচারী সরকার তাদের দেয়নি। ফলে তারা স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের উচিত সাধারণ মানুষের কথা উপলব্ধি করে দৈনন্দিন জীবনে তারা যে নিদারুণ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে তাদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য যা করণীয়, তা করা। সরকার আইনের শাসন, সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি নিশ্চিতে প্রশাসন ও রাষ্ট্রের সব যন্ত্রের সংস্কার করবে ঠিকই, তবে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন সহজ ও স্বস্তিদায়ক যাতে হয়, সবার আগে সে উদ্যোগ নিতে হবে। বলাবাহুল্য, সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকলে সরকারের প্রতি তাদের সন্তোষ ও সমর্থন দুটোই থাকবে। এতে সরকারের কাজ করা সহজ হবে। সরকারকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করে নিত্যপণ্যের মূল্য যুক্তিসংগত পর্যায়ে স্থিতিশীল রাখার পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও সভাপতি গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপি। প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ