বৈষম্যহীন আচরণ মানেই ন্যায়পরায়ণতা। আরবিতে বলে আদল বা ইনসাফ। মানবীয় চারিত্রিক গুণাবলির মাঝে শ্রেষ্ঠতম একটি গুণ। ন্যায়পরায়ণতার ছোঁয়াহীন সমাজ যেন ধু-ধু মরুপ্রান্তর। যেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত। বিচারের বাণী যেখানে নিভৃতে কেঁদে মরে। পক্ষান্তরে ন্যায়পরায়ণতার সৌরভে সুরভিত সমাজ যেন মাটির পৃথিবীতে জান্নাতের এক অনিন্দ্য সুন্দর ঝলকানি। সুন্দর সুসম উন্নত সমাজ গড়তে সমাজের প্রতিটি মানুষের চেতনাজুড়ে ন্যায়পরায়ণতা বা বৈষম্যহীন মানসিকতার সৌরভ ধারণের বিকল্প নেই। মানবজাতির সফলতার একমাত্র ঠিকানা ইসলামে ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা তাই সর্বাগ্রে। কোরআন মাজিদে সুদৃঢ়ভাবে স্পষ্ট ভাষায় ইরশাদ হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদল করার (ন্যায়পরায়ণতা) হুকুম দেন’ (সুরা নাহল-৯০)।
ইসলামে ন্যায়পরায়ণতার গুরুত্ব এত বেশি যে, ইসলাম শত্রুদের অপছন্দনীয় কর্মকান্ড সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে ন্যায়পরায়ণতার আদেশ দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, “কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদের আদল (ন্যায়পরায়ণতা) পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন কর। এই পন্থাই তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী” (সুরা মায়িদা-৮)।
ন্যায়পরায়ণতা সব বিষয়ের যথাযথ মূল্য প্রদান করে। ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমেই মানুষের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। যে জাতির মাঝে ন্যায়পরায়ণতার সৌরভ আছে, তাঁরা সৌভাগ্যবান এবং উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায় উন্নীত। পক্ষান্তরে ন্যায়পরায়ণতার সৌরভ থেকে বঞ্চিত জাতি নিঃসন্দেহে দুর্ভাগা এবং নিচুতার তকমা ধারণকারী। মানবজাতির শ্রেষ্ঠ শিক্ষক রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর অনুসারীদের ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দিয়েছেন, ন্যায়পরায়ণতার সৌরভে সুরভিত জীবন গড়তে উৎসাহিত করেছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) রসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন- “সুবিচারক লোক আল্লাহতায়ালার নিকট তাঁর ডান হাতের দিকে নূরের মিম্বরের ওপর উপবিষ্ট থাকবেন। যারা তাদের বিচারকার্যে, পরিবারে ও দায়িত্বভুক্ত বিষয়ে ইনসাফ রক্ষা করে। রাবি মুহাম্মদ (রহ.) তাঁর হাদিসে বলেন : আল্লাহর উভয় হাতই ডান হাত (সুনানে নাসায়ি)।
নবীজি (সা.)- এভাবেই বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে ন্যায়পরায়ণতার বীজবপন করেছেন। তাছাড়া রসুলুল্লাহ (সা.) দ্যুতিময় পবিত্র জীবনের পুরোটাই ন্যায়পরায়ণতার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ। নবুওতপ্রাপ্তির আগেই তিনি অত্যাচারিতের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার বিমল চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মক্কায় আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের বাড়িতে কুরাইশের চিন্তাশীল যুবকদের সমন্বয়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। কাবা পুনর্নির্মাণের সময় “হাজরে আসওয়াদ” স্থাপন নিয়ে কুরাইশদের মাঝে সৃষ্ট সংঘাতময় পরিস্থিতি নিরসনে সর্বসম্মতিক্রমে নবীজি (সা.) বিচার ও ন্যায়পরায়ণতার ওপর আস্থা রাখা হয়েছিল।
নবুওতপ্রাপ্তির পর রসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের চেতনাজুড়ে ন্যায়পরায়ণতার সৌরভ ছড়িয়ে দিয়েছেন সুদৃঢ়ভাবে। নবী-জীবনের ন্যায়পরায়ণতার বিমল সৌরভজড়ানো একটি ঘটনা, যা কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীবাসীর সামনে ন্যায়পরায়ণতার অনন্য স্মারক হয়ে আছে। ঘটনাটি সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, মাখযুমি গোত্রের এক মহিলার ব্যাপারে কুরাইশ বংশের লোকদের খুব দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল যে চুরি করেছিল। সাহাবাগণ বললেন, রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কে কথা বলতে পারবে? আর রসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয়জন উসামাহ (রা.) ছাড়া এটা কেউ করতে পারবে না। তখন উসামাহ (রা.) রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কথা বললেন। এতে তিনি বললেন : তুমি আল্লাহর শাস্তির বিধানের ব্যাপারে সুপারিশ করছ? এরপর তিনি দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিলেন এবং বললেন : হে মানবমন্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের আগের লোকেরা গুমরা হয়ে গিয়েছে। কারণ, কোনো সম্মানী ব্যক্তি যখন চুরি করত তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত তখন তার ওপর শরিয়তের শাস্তি কায়েম করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে তবে অবশ্যই মুহাম্মদ (সা.) তাঁর হাত কেটে দেবে (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৬৭৮৮)।
রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর দীর্ঘ জীবনে ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতাকে প্রতিষ্ঠা করার সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়েছেন। নিজের মাঝেও শতভাগ ন্যায়পরায়ণতার সৌরভ ধারণ করেছেন সুদৃঢ়ভাবে। সিরাতের পাতায় পাতায় নবীজি (সা.) ন্যায়পরায়ণতার গল্পগুলো ছড়ানো আছে মণি-মুক্তার মতো। যেগুলো পাঠকালে একজন পাঠক আলোড়িত হন, শিহরিত হন দারুণভাবে। একবার মুনাফিক রসুলুল্লাহ (সা.) ন্যায়পরায়ণতায় কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করেছিল। তখন নবীজি (সা.) অত্যন্ত দৃঢ়তা ও প্রতাপের সঙ্গে সেই কথাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর