আল্লাহর সৃষ্টি কুশলতার কোনো তুলনা নেই। তিনি আমাদের অতি সুন্দরভাবে সৃষ্টি করার পর শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে উপকৃত হওয়ার পদ্ধতিও শিখিয়েছেন। অঙ্গগুলোর সহযোগিতা নিয়েই আমি পূর্ণাঙ্গ মানুষ। জীবনের হাজারো প্রয়োজন পূরণে, উদ্দেশ্য সাধনে আমি আল্লাহর দেওয়া অঙ্গের স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা পাই। শরীরের একটা অঙ্গ যদি আমাকে সহযোগিতা না করে তাহলেই আমি অস্থির হয়ে পড়ি। চিন্তা করুন তো, আপনার চোখ আপনাকে সহযোগিতা না করলে দুনিয়ার জীবনটা আপনার কেমন হতো? আমরা কি কখনো চিন্তা করি যে, আল্লাহতায়ালা এতগুলো অঙ্গ কেন বানালেন? এক অঙ্গকে অন্য অঙ্গের মুখাপেক্ষী বানিয়েছেন কেন? আল্লাহ নিজেই এই চিন্তার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যদি আমার ব্যাপারে তোমাদের কোনো প্রশ্ন জাগে তাহলে তোমাদের শরীরে তালাশ করো, উত্তর পেয়ে যাবে। এই যে, আমার প্রশ্ন জাগছে যে, আল্লাহ শুধু এমন একটি অঙ্গ সৃষ্টি করলেন না কেন, যা চোখের কাজ করত, দেমাগের কাজ করত, হাত, পা, নাক, কান সবকিছুর কাজ করত? আল্লাহ তো অসীম ক্ষমতার অধিকারী। একটি অঙ্গ দ্বারাই সব কাজ করাতে পারেন। এতগুলো অঙ্গের কী দরকার? আল্লাহ বলেন, এর উত্তর তোমার শরীরের মধ্যে গভীরভাবে গবেষণা করলে পেয়ে যাবে। উত্তর হলো, তোমার শরীরের সব অঙ্গ সুস্থ থাকলে এবং একটি অন্যটিকে সহযোগিতা করলে তোমার ভালো লাগে, নিরাপদ থাক। এমনিভাবে পৃথিবীর সব মানুষ চাই সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম, একটা শরীরের মতো।
স্বভাবগতভাবে মানুষকে আল্লাহপাক একে অপরের মুখাপেক্ষী বানিয়েছেন। আমি ড্রাইভারের মুখাপেক্ষী, ড্রাইভার আমার মুখাপেক্ষী। চাকর মালিকের মুখাপেক্ষী, মালিক চাকরের মুখাপেক্ষী। ডাক্তার রোগীর মুখাপেক্ষী, রোগী ডাক্তারের মুখাপেক্ষী। ইঞ্জিনিয়ার বাড়ির মালিকের মুখাপেক্ষী, বাড়ির মালিক ইঞ্জিনিয়ারের মুখাপেক্ষী। মুসল্লি ইমাম সাহেবের মুখাপেক্ষী, ইমাম সাহেব মুসল্লিদের মুখাপেক্ষী। সৃষ্টিগতভাবে আল্লাহপাক যেমন শরীরে অনেক অঙ্গ রেখেছেন ব্যক্তির শান্তি-নিরাপত্তার জন্য, তদ্রূপ সামাজিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, ইমান ও আমলের দুনিয়া ও আখেরাতের নিরাপত্তা, সব ক্ষেত্রেই মানুষের অপরের মুখাপেক্ষী বানিয়েছেন। অন্যের প্রতি দয়া করা, অন্যের দুঃখ-কষ্ট দেখে মন ব্যথিত হওয়া এবং সাহায্য করতে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কল্যাণকর স্বভাব আল্লাহ আমাদের এসব দান করেছেন। সমাজসম্পন্ন ব্যক্তিকে আমরা পরোপকারী বলি, জনদরদি, বলি। এ গুণের কিছু অংশ ডাক্তারের মধ্যে আছে, কিছু অংশ ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে আছে, তদ্রূপ কিছু অংশ গরিবের মধ্যে, কিছু অংশ ধনীর মধ্যে, কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মধ্যে, কিছু যুবক-যুবতীর মধ্যে, কিছু আলেমের মধ্যে, কিছু ইমামদের মধ্যে, কিছু মুসল্লির মধ্যে, এভাবে সবার মধ্যে ভাগ করা আছে। সব গুণ তো একজনের মধ্যে থাকে না। আদর্শ ডাক্তার যখন রোগী দেখে তখন কত দেবে না দেবে সেদিকে লক্ষ্য করে না। আগে রোগী বাঁচানোর চেষ্টা করে। যেমন কোনো ব্যক্তি পানিতে পড়ে গেলে তাকে আগে তুলে এনে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়।
আল্লাহর দান করা দয়া-মায়া, ক্ষমার স্বভাব যদি সমাজের লোকের মধ্যে থাকে, দেশের নাগরিকদের মধ্যে থাকে তাহলে পুরো দেশে শান্তির সুবাতাস বইবে সর্বদা। যেমন ছিল হজরত সাহাবায়ে কেরামের জমানায়। অনুসরণ করতে হলে নবীর জিন্দেগিকে, সাহাবিদের জিন্দেগিকে করতে হবে। আল্লাহকে অস্বীকারকারী, আল্লাহর দীনকে অমান্যকারী কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা জাতির কথা, কাজ ও চিন্তাধারার অনুসরণ অনুকরণে শান্তির দেখা মিলবে না আদৌ। খোলাফায়ে রাশেদিন কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন? ধনী-বিত্তশালীদের কাছ থেকে জাকাত আদায় করে গরিবদের দিয়েছেন। ফলে সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য ঠিক ছিল। বেকার বাড়েনি, চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারী-সন্ত্রাসী জন্ম নেয়নি। কোরআনে কারিমে শব্দ এনে আল্লাহপাক বলেছেন, হে বিত্তশালীরা! আমি তোমাদের যেভাবে অগণিত নেয়ামত দিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছি, আমার দেওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে তোমরা আজ অর্থের পাহাড় গড়েছ, তেমনি আমার দুস্থ, অসহায় বান্দাদের এহসান করো, সাহায্য করো। কৃপণতা করো না। মাল তো আমি দান করেছি, তা থেকে দেওয়ার ক্ষেত্রে তুমি কৃপণতা করো কেন? আমি যদি এখন তোমার থেকে সম্পদ কামাই করার মেশিনগুলো অকেজো করে দিই, অর্থাৎ চোখ, কান, হাত, পা, জবান, আকল ইত্যাদি অঙ্গসমূহ নষ্ট করে দিই তখন কী হবে তোমার অবস্থা? আমি অনেককে কোটিপতি, বিত্তশালী করেছি যাতে তারা তাদের আশপাশের গরিব-অসহায়দের সাহায্য করে, দয়া-মায়ার দৃষ্টিতে দেখে। কৃপণতার কুফল কৃপণ যে ব্যক্তি হয় সে নিজে এবং নিজের পরিবারের জন্যই খরচ করতে চায় না, অন্য জনকে দান করতে বললে তো তার শরীরে আগুনের ফুলকি এসে পড়ে। কৃপণ মানুষকে আল্লাহতায়ালা ভালোবাসেন না। হাদিসেপাকে আছে, দুটি বিষয় অত্যন্ত খারাপ- ১. কৃপণতা ২. বদ-চরিত্র। হাদিসে আরও এসেছে, যে কৃপণ সে যেন নিজেকে মুমিন হিসেবে পরিচয় না দেয়।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ