বিএনপি সরকারের কাছে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করছে। এ দাবিকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ দেশের বৃহত্তম দলটির প্রতি নাখোশ হয়ে উঠেছেন। তাদের কথা আগে সংস্কার তারপর নির্বাচন। আওয়ামী লীগের পৌনে ১৬ বছরের অপশাসন দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলেছে। নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার নিয়ে গণতন্ত্রকামী কোনো মানুষের আপত্তি নেই। কিন্তু সংস্কারের কারণে নির্বাচন বিলম্বিত হলে তাতে ষড়যন্ত্রকারীরাই লাভবান হবে। নির্বাচন কবে হবে সে বিষয়ে জনমনে যাতে সংশয় দানা বেঁধে না ওঠে তা নিশ্চিত করতেই আগেভাগে রোডম্যাপ ঘোষণায় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান এক বিরাট অর্জন। হাজারো মানুষের রক্তের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে তা কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। কোনোভাবেই যাতে প্রতিবিপ্লবীরা সুযোগ না পায় সচেতন থাকতে হবে। আরব বসন্ত তিউনিশিয়া ও মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ এনে দিয়েছিল। তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও মিসরে প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের জয় কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যাতে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে তা নিশ্চিত করতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জড়িত সব দলকে সচেতন থাকতে হবে। এ বিষয়ে কেউ হটকারিতার পথ বেছে নিলে তা হবে আত্মহননের শামিল।
দেশের মানুষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায়। দেড় দশক ধরে দেশের ১৮ কোটি মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। যে কারণে বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপের কথা প্রথম থেকেই বলে আসছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বিশ্বাস করে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার শুরু করা। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার এবং ভোটার তালিকা তৈরির পর নির্বাচনের আয়োজন করা। নির্বাচনে যারা জয়ী হবে তাদেরও উচিত হবে জাতীয় সরকার গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, তার দল নির্বাচনে জয়ী হলে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে নিয়ে তারা সরকার গঠন করবেন। দেশবাসীর সামনে দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। সবারই জানা, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সংস্কার টেকসই হয় না। বাংলাদেশ কিংবা যে কোনো দেশেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং সরকার প্রতিষ্ঠাই অন্তর্বর্তী সরকারের সব সংস্কার কার্যক্রমের প্রথম এবং প্রধান টার্গেটও হওয়া জরুরি। ক্ষমতার পরিবর্তন মানে শুধুই রাষ্ট্রক্ষমতার হাত বদল নয়। ক্ষমতার পরিবর্তন মানে রাষ্ট্র এবং রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। তাই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আচার-আচরণেও গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশের বীর ছাত্র-জনতা, নারী-শিশু, কৃষক-শ্রমিক সব শ্রেণি-পেশার সর্বস্তরের জনগণ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিতে রাজি, তবুও স্বৈরশাসন মেনে নিতে রাজি নয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন, হাত-পা-চোখ হারিয়েছেন কিংবা চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন- দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ আজীবন তাদের আত্মত্যাগ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। হতাহতদের পরিবারের প্রতি অবশ্যই রাষ্ট্রকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানে নব্য ফ্যাসিস্টদের পতন ঘটলেও তারা বসে নেই। পর্দার আড়ালে চলছে নানা ষড়যন্ত্র। দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য উন্মুখ। নির্বাচন অনুষ্ঠান বিলম্ব হলে তা ষড়যন্ত্রকারীদের হাত শক্তিশালী করবে। বলা হয়ে থাকে, অর্থনীতি হলো রাজনীতির প্রাণ। দেশের অর্থনীতি যে ভালো নয় তাতে দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। হু হু করে বাড়ছে চাল ডাল তেল সবজি ডিমসহ সব পণ্যের দাম। ৫ আগস্ট আওয়ামী বাকশালীরা ক্ষমতা থেকে পালিয়েছে। তাদের দোসররা কয়েক দিন গাঢাকা দিলেও তারা আবার ইঁদুরের গর্ত থেকে বের হয়ে অপকর্ম ঘটাচ্ছে। গোপালগঞ্জের পর নরসিংদীতে তারা ফণা তুলেছে। ছাত্রলীগ নামের দুর্বৃত্তদের হাতে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার বাটিয়ারা গ্রামে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ছাত্রদল কর্মী জুনায়েদ আল হাবিব হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রুহুল কবির রিজভী ভাইয়ের নেতৃত্বে গিয়েছিলাম জুনায়েদের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে। আমরা বিএনপি পরিবারের উদ্যোগে আমাদের নেতা তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা তুলে দিতে। আমরা চাই না দেশের আর কোথাও পরাজিত শক্তির দোসরদের হাতে আমাদের কোনো কর্মী প্রাণ হারাক। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়েছে। গোপালগঞ্জ ও রায়পুরায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের তাণ্ডবে যারা প্রাণ হারিয়েছেন সেই খুনিদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা আমরা দেখতে চাই। বিদ্যুৎ ঘাটতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর ফলে কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কলকারখানার নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠা চলছে শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে। শেয়ারবাজারের ধস কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। ফলে দেশবাসী একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চাচ্ছেন। যারা জনগণকে নিয়ে প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। বিশৃঙ্খল অবস্থার রাশ টেনে ধরবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এ মুহূর্তের কর্তব্য হওয়া উচিত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা। এ রোডম্যাপ কার্যকর করার স্বার্থে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত করাও তাদের দায়িত্ব বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর যে কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই সে বিষয়টি স্পষ্ট। এ সরকারের সুনামের স্বার্থেই জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচনের বিষয়ে ঘোষণা দিতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের থাবা ভাঙতে সমাজের সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে ব্যবসাবাণিজ্য শিল্প খাতে যে অস্বস্তিকর অবস্থা চলছে তার অবসান ঘটাতে গড়ে তুলতে হবে আস্থার পরিবেশ।
দেশের ব্যবসাবাণিজ্য অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে প্রায় দুই বছর ধরে। গত অর্থবছরে বন্ধ হয়েছে ২৭৫টি কলকারখানা। একটি দৈনিকের খবরে প্রকাশ, গত দুই মাসে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের দেড় শতাধিক ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে গত তিন মাসে ৮৩টি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা শিল্পকলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া মানেই সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেকার হওয়া। বিনিয়োগ আকর্ষণের নতুন কোনো উদ্যোগ না থাকায় দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন না। দেশের অর্থনীতির জন্য যা একটি অশনিসংকেত। বিগত সরকারের আমলে মন্দার মুখেও যেনতেন করে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় লোকসান থেকে নিষ্কৃতি পেতে বিপুলসংখ্যক কোম্পানি তাদের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থায়ীভাবে ব্যবসা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেই সে পথে হাঁটছে তারা। অন্তত ১৬০টি কোম্পানি বন্ধের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। এর মধ্যে বড় গ্রুপের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে নিবন্ধন নেওয়া কোম্পানিও রয়েছে বন্ধের তালিকায়। বন্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলারের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠার জন্য ব্যবসাবাণিজ্যে সংকট চলছে। ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, ডলার সংকট ব্যবসা পরিচালনা কঠিন করে তুলেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতারও শিকার হয়েছেন ব্যবসাবাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থা মোকাবিলায় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াতে হবে সরকার ও প্রশাসনকে। রাজনৈতিক দলগুলোরও কর্তব্য হবে তাদের সাহস জোগানো। কলকারখানার নিরাপত্তার প্রশ্নে নিতে হবে জিরো টলারেন্স। শ্রমিক অসন্তোষের প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক