একটি গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য হলো সেখানে সবার কথা বলার ও রাজনীতি চর্চার সমান সুযোগ থাকে। দল, মত, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই এরূপ সমাজের লক্ষ্য। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনও হয়েছিল সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। তবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ এর যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গত ১৫ বছর ফ্যাসিবাদী সরকার ব্যবস্থায় জুলাই হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন, খুন, গুম, ভোটাধিকার হরণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসসহ নানাভাবে স্বাধীনতার লক্ষ্যকে নষ্ট করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর বিভিন্ন পক্ষ থেকে সেই সরকারের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি উঠেছে।
দ্বিমত থাকার কথা নয় যে, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে গত ১৫ বছর বাংলাদেশের জনগণ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম শাসন দেখেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে পরিমাণ দমনপীড়ন ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তা বাংলাদেশের আর কোনো শাসনামলে দেখা যায়নি। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বৈরাচারী সরকার সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগ করেছে। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের নামে স্বৈরাচারী সরকারপ্রধানের নির্দেশনায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ ছাত্র-জনতাকে খুন করা হয়েছে। এখনো অনেকে নিখোঁজ, হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। গত ১৫ বছর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সুষ্ঠুভাবে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হয়নি। বিরোধী দলগুলোর ওপর এক ধরনের ‘আন-অফিশিয়াল’ নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো বিরোধী দলের উপস্থিতি ও তাদের নিয়মতান্ত্রিক ‘বিরোধিতা’। কিন্তু এ দীর্ঘ অপশাসনের সময় বিরোধী দলগুলোকে কোনোরকম সুযোগই দেওয়া হয়নি। বিরোধী দলগুলোকে নাই করে দেওয়ার একটা ফ্যাসিবাদী কালচার চর্চা করা হতো। হামলা, মামলা, রাজনৈতিক অফিসে তালা লাগিয়ে দেওয়া, যে কোনো কর্মসূচিতে ‘নিরাপত্তার’ অজুহাত দেখিয়ে অনুমতি না দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিক মাঠ থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
এসব ঘৃণ্য কাজের জন্য দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধের দাবি ‘অযৌক্তিক’ নয়। দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে আওয়ামী লীগসহ এর নেতৃবৃন্দের ওপর মানুষ অস্বাভাবিকরকম ক্ষিপ্ত। ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। কিন্তু নিষিদ্ধ করলেই কি গণতন্ত্রের পথ মসৃণ হবে?
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো সবাইকে কথা বলতে দেওয়া। এমনকি নিজের মতের সঙ্গে অমিল হলেও অন্যকে তা প্রকাশ করতে দেওয়া। কিন্তু ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের ‘ন্যারেটিভ’-এর বাইরে সমাজে আর কোনো মতামত প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। কারও মত যদি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে যেত তাহলে ওই ব্যক্তির ‘মুখ চেপে’ ধরা হতো। যে কোনো সমালোচনাকেই সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে ধরে ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে শুরু করে জেল-জুলুম এমনকি হত্যাও করা হতো। তাছাড়া আওয়ামী লীগের সমালোচনা করা মানেই ‘বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ট’, ‘দেশ বিরোধী’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী’ ইত্যাদি তকমা দেওয়া হতো। এগুলো সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চার জন্য খুবই ক্ষতিকর।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমানে আওয়ামী লীগ কার্যত ‘বিরোধী দলে’ পরিণত হয়েছে। যদিও কোনো রাজনৈতিক দলই এখন ক্ষমতায় নেই, কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতনের পর তারাই এখন ‘বিরোধী’ দলের মতো হয়ে গেছে। এখন যদি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে তা ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতিরই পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন করতে হলে আওয়ামী লীগেরও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত, তবে অপরাধের জন্য তাদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের ব্যাপার থাকাটা উচিত নয়। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা ক্ষেত্রবিশেষে সমাজে চরম পন্থার জন্ম দেয়। সমাজে মেরুকরণ বাড়ায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরিতে বাধাগ্রস্ত করে। দল নিষিদ্ধ, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা, বাক-স্বাধীনতা হরণ করা এগুলো ফ্যাসিবাদী কারবার। বাংলাদেশে বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয় কিন্তু ইতিহাস বলে যারা নিষিদ্ধ করার আয়োজন করে তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। তাছাড়া দল নিষিদ্ধের রাজনীতি কূটকৌশল হিসেবেও বিবেচিত হয়। ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারকে এ কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। গণআন্দোলনে যখন তার পতন সন্নিকটে তখন ‘নির্বাহী আদেশে’ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে ফাঁদ পেতেছিল। আন্দোলনকে নানাভাবে ‘ট্যাগিং’ দিয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলন ফ্যাসিবাদের সব ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে বিজয় নিশ্চিত করেছে। রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে তা যেন কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
প্রশ্ন আসতে পারে যারা দলীয় বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে সন্ত্রাস, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে তাদেরকে কি রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত? যারা গণহত্যা চালায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তাদের কি রাজনৈতিক অধিকার থাকা উচিত? এ প্রশ্নের সরল উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে দুভাবে এর সমাধান করা যায়। এক. তাদের আদালতে বিচারের সম্মুখীন করে রায়ের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কেউ যদি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকে তাকে সন্ত্রাস দমন আইনের অধীনে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। দুই. জনমতের ভিত্তিতে সেই দলকে প্রত্যাখ্যান করা। এ বিবেচনায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করে সব অপকর্মের জন্য বিচারের সম্মুখীন করাই শ্রেয়। আওয়ামী লীগ যদি গণবিরোধী রাজনৈতিক দল হয় জনগণকেই সেই দলকে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ দিতে হবে। জনগণই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। যেমনটা নির্ধারণ করেছিল ৫ আগস্ট। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে একটি দলের অধিকাংশ সদস্যই যখন অপকর্ম দ্বারা বেষ্টিত হয় তখন সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত দেশের স্বার্থে সেই দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নজরে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতে যেন কোনো সরকার ফ্যাসিবাদী না হয়ে ওঠে সে জন্য বিগত শাসনামলে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলোকে বিচারের আওতায় এনে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। আওয়ামী লীগ যদি দল হিসেবে অপরাধী প্রমাণিত হয় তাহলে দল হিসেবে তার বিচার করতে হবে। আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মী অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তবে যারা কোনো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল না তারা যেন হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেউ যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সামগ্রিকভাবে ‘জুলাই অপরাধ’-এর জন্য সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা উচিত যাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে আদালত প্রাঙ্গণে ‘অপরাধীর’ ওপর হামলা ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে। ‘মব’ দিয়ে আর যাই হোক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায় না। অপরাধীর বিরুদ্ধে বিচারের দাবি উত্থাপন করা যায়, তাকে বিচারের অধীনে আনা যায় কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বিচারাধীন ব্যক্তির গায়ে হাত তোলাটা ভালো কাজ নয়। স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হয়ে একটা গণতান্ত্রিক সমাজ তৈরি করতে গিয়ে যেন খারাপ কিছু তৈরি না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
বিগত ১৫ বছরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে গ্রাম পর্যন্ত অপরাধের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ছিল। ফ্যাসিবাদী এ অপরাধ চক্রকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। তবে নামে-বেনামে মামলা না দিয়ে সুনির্দিষ্ট অপরাধের ভিত্তিতে মামলা প্রদান ও বিচারকার্য সম্পাদন করতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম পূর্বশর্ত। যে সমাজে কেউ অপরাধ করে দায়মুক্তি পায়, সে সমাজে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়ে। জবাবদিহিমূলক সমাজ ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য জুলাই-আগস্টে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার বিচার নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা