রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
শিক্ষা ও শিক্ষক

মেধা যাচাই করতে হবে জ্ঞানের ভিত্তিতে নম্বরের ভিত্তিতে নয়

মেধা যাচাই করতে হবে জ্ঞানের ভিত্তিতে নম্বরের ভিত্তিতে নয়

দেশের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেইসঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে দেশে কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর জোরারোপ করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়, শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে সংশ্লিষ্টদের করণীয়, শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নয়নে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ —রোকেয়া আকতার বেগম

 

প্রশ্ন : শিক্ষার সব স্তরেই পাসের হার বেড়েছে। তবে শিক্ষার সামগ্রিক গুণগত মান বেড়েছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। শিক্ষার গুণগত মান প্রত্যাশা অনুযায়ী না বাড়ার কারণ কি?

 

উত্তর : শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির হার আশাব্যঞ্জক হয়নি। এর  পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। যেমন :  বিষয়ভিত্তিক সিলেবাস প্রণয়নে কিছুটা ভুলত্রুটি রয়েছে যা প্রত্যাশিত না; বিষয়ভিত্তিক বইগুলোর লেখাও সেভাবে পরিপূর্ণ নয়। কোনো তত্ত্বের ব্যাখ্যায় যেখানে বিশদ বর্ণনা থাকা উচিত ছিল সেখানে দেখা যায় খুব সংক্ষিপ্ত করে লেখা হয়েছে, ফলে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারছে না,  না বুঝেই মুখস্থ করে লিখছে যা মেধা বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে; বেশিরভাগ শিক্ষকই বিষয়গুলোর বিশদ না বুঝিয়ে কতগুলো গতানুগতিক প্রশ্ন এবং উত্তর মুখস্থ করান, অভিভাবক ও ছাত্রদের বেশিরভাগই তথাকথিত কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে; প্রশ্ন ফাঁস ও পরীক্ষার হলে দেখাদেখি করে লেখা, প্রভাবশালী স্কুলগুলো নিজের সুবিধামতো বিশেষ কোনো স্কুল বা কলেজে বোর্ডে প্রভাব খাটিয়ে সিট ফেলার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীরা বিষয়বস্তুর গভীরে প্রবেশ না করে বেছে বেছে প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষা দিচ্ছে, ফলে শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে; শ্রেণিকক্ষে পাঠ আলোচনার সময় খুব কম দেওয়া হচ্ছে, মর্নিং শিফট ও ডে শিফট থাকায় রুটিনে সময় বণ্টন খুবই সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে; রুটিনে সময়বণ্টন বিষয়ভিত্তিক গুরুত্বের ওপর করতে হবে। সিলেবাস দ্রুত শেষ করলে অনেক শিক্ষার্থীই বিষয়টি বুঝতে পারে না; সারাদিন স্কুল করার পর কোচিং সেন্টারে পড়তে যাওয়া তারপর বাসায় এসে আবার প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে বসা ইত্যাদি কারণেও শিক্ষার্থীরা বুঝে চিন্তা করে পড়ার সময় পাচ্ছে না। ফলে লেখাপড়া তাদের কাছে আনন্দের না হয়ে ভীতিজনক হয়ে পড়েছে; স্কুলগুলোতে ঘন ঘন পরীক্ষা নেওয়ার রীতিতে শিক্ষার্থীরা ক্লান্ত এবং বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। খেলাধুলা, বিনোদন, ভ্রমণ সংস্কৃতি চর্চা ইত্যাদিতে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারে না; সৃজনশীল শব্দটির অযথাযথ ব্যবহার ও বাস্তবায়ন;   শিক্ষকদের জন্য যথাযথ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় তারাও বাজারের গাইডবই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন এবং শিক্ষার্থীরা গাইডবই পড়তে বাধ্য হয়ে পড়েছে। ফলে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে; সাহিত্যের বই আরও বাস্তবমুখী হতে হবে ইত্যাদি।

 

প্রশ্ন : শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকরা কি ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা দিতে হলে শিক্ষকদের নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। বিষয়বস্তুর ওপর ভালো লেখাপড়া করে ক্লাসে পাঠদান করতে হবে যা বেশিরভাগ শিক্ষকরা করেন না। যে বিষয়টি পড়াবেন সে বিষয়ে শুধু বইয়ের অংশটি না বুঝিয়ে প্রাসঙ্গিক আরও বিস্তৃতভাবে বুঝাতে হবে। যেসব শিক্ষক সাহিত্য পড়ান, তাদের উচিত জীবনবোধ, মূল্যবোধ, মানবতা ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে ২ মিনিট বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বোঝানো। 

প্রশ্ন : প্রশ্ন আছে, বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় সময়োপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। এ থেকে উত্তরণে করণীয় কি?

উত্তর : আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থায় যেতে হলে সম্পূর্ণ সিলেবাস পরিবর্তন করে উন্নয়নশীল দেশের সিলেবাস আলোচনা করে সিলেবাস তৈরি করতে হবে। ভালো শিক্ষক, ভালো গবেষক, ভালো প্রযুক্তিবিদ তৈরি করতে হলে বিষয়ের বিশদ আলোচনাভিত্তিক বই তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের তাদের আগ্রহের বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতে হবে। তবেই গায়ক, নায়ক, বিজ্ঞানী, গুণী শিক্ষক, ডাক্তার, প্রযুক্তিবিদ, চিত্রকর, খেলোয়াড় ইত্যাদি তৈরি হবে।

প্রশ্ন : প্রাথমিক স্তরের পিএসসি ও মাধ্যমিক স্তরের জেএসসি পরীক্ষা আর থাকছে না বলে শোনা যাচ্ছে। এটিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

উত্তর : পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বেশি পরীক্ষা শিশুদের সুকুমার বৃত্তির বিকশিত হওয়াকে ব্যাহত করছে।  এতে করে প্রাইভেট টিউটর ও কোচিং সেন্টারের পেছনে অর্থ ব্যয় ও হয়রানি কমে আসবে, সময় বাঁচবে। ফলে শিশুরা খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, লাইব্রেরিতে পড়াশোনা, বিজ্ঞান প্রজেক্ট করা, বিতর্ক করা ইত্যাদি শিক্ষামূলক বিনোদনে অংশগ্রহণ করতে পারবে যা শিশুদের সঠিক বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক হবে।

প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ার আগ্রহ কমে গেছে বলে বিভিন্ন গবেষণা বা জরিপে দেখা গেছে। এর কারণ কি? এ থেকে উত্তরণে করণীয় কি?

উত্তর : লেখাপড়া শেষ করে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। এছাড়া বিজ্ঞান বিষয়ে চাকরির ক্ষেত্র সীমিত। মেধানুযায়ী সম্মানী কম হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ ছাড়া শ্রেণিকক্ষে যেভাবে পড়ানো উচিত সেভাবে বেশিরভাগ শিক্ষক পড়াচ্ছেন না, ব্যবহারিক কাজগুলো বেশিরভাগ স্কুলে করানো হয় না। মুখস্থ করতে বলা হয়। বিদ্যমান বিজ্ঞান বিষয়ের বইগুলোয় পরিবর্তন আনা উচিত।

প্রশ্ন : মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কমিউনিকেটিভ ইংরেজি চালু আছে। এটি কতটা সফল হয়েছে?

উত্তর : শিক্ষার্থীরা কমিউনেকেটিভ ইংলিশ শিখছে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য, কিন্তু ইংরেজি বইতে কোনো সাহিত্য নেই। এতে ইংরেজিতে জ্ঞানের গভীরতা কমে গেছে। আমি মনে করি, কমিউনিকেটিভ ইংরেজির পাশাপাশি ভালো মানের কবিতা, গল্প এবং সাহিত্যও বইয়ে থাকতে হবে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা কমবেশি ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেও তাদের যথাযথ জ্ঞান আহরণ হচ্ছে না।

প্রশ্ন : আধুনিক সময় বেশ প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে। এ প্রতিযোগিতায় সাফল্যের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার্থীদের করণীয় কি বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : প্রতিযোগিতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো তবে সেটি মুখস্থ বিদ্যাভিত্তিক না হয়ে মেধাভিত্তিক হওয়া উচিত। প্রশ্নে নৈর্ব্যক্তিক অংশ থাকার বিষয়টি পুর্নবিবেচনা করা উচিত। এটি একটি মুখস্থের বিষয়। শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয় ভালো করে শিখেছে বা বুঝেছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য মানসম্মত প্রশ্ন তৈরি করতে হবে। জ্ঞানের ভিত্তিতে মেধা যাচাই করতে হবে, নম্বরের ভিত্তিতে নয়।

প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধসহ অন্যান্য যাবতীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের করণীয় কি?

উত্তর : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টরা শিক্ষার্থীদের জন্য বাস্তবমুখী, জীবনমুখী ও কর্মমুখী, মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, সত্ চরিত্র গঠনে সহায়ক, দেশ ও জাতির উন্নয়নকল্পে বিজ্ঞানমনস্ক হবে এমন কাজগুলো করবেন। সিলেবাস সেই আলোকে প্রণয়ন করতে হবে। বই লিখতে হবে একই আলোকে। ছোটবেলা থেকে ভালো ভালো গল্প পড়তে বলা, জীবনবোধের ওপর যারা লিখেছেন তাদের বই পড়তে উত্সাহিত করা, বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য মানসিকভাবে অভিভাবক এবং শিক্ষক শিক্ষার্থীদের তৈরি করবেন। অনেক অভিভাবক মনে করেন, শিক্ষামূলক বিনোদনে অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে, এটি তাদের ভুল ধারণা। এগুলো হচ্ছে প্রতিটি শিশুর নিজস্ব মেধা বিকাশে সহায়ক। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সমঝোতা রেখে প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সবচেয়ে বেশি এই গুরুদায়িত্ব নিতে হবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে গবেষণামূলক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মুখস্থ করা বিদ্যা, খাতায় বেশি নম্বর দিয়ে পাসের হার বাড়ানো এসব চিন্তা বাদ দিতে হবে।

প্রশ্ন : গত কয়েক বছর ধরেই দেশে কর্মমুখী শিক্ষার সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

উত্তর : এর সঙ্গে আমরা একমত। তবে বাস্তবসম্মত কর্মমুখী শিক্ষা হতে হবে যা শিক্ষার্থীর বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়ক হয়।  যাতে করে তারা সুন্দর নির্মল ও সত্ভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে সেজন্য সঠিক কর্মমুখী শিক্ষা জরুরি।

প্রশ্ন : বিদ্যমান শিক্ষায় মেধাবী কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ। এর জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে কি কোনো সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?

উত্তর : কথাটি অত্যন্ত সঠিক। শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল সংস্কার করতে হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ে গভীরতা নিয়ে চিন্তা করবেন বলে আশা করি। তারা গবেষণামূলক নীতি নির্ধারণ করবেন। না তা হলে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রত্যাশামাফিক মেধাবী কর্মী পাওয়া যাবে না।

প্রশ্ন : শহরাঞ্চলের শিক্ষাঙ্গনে খেলার মাঠ নেই। ফলে পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। এতে মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কি পিছিয়ে পড়ছে?

উত্তর : আমি এ বিষয়ে একমত। তবে শুধু খেলার মাঠ না থাকা নয়, ঘন ঘন পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কারণেও শিক্ষার্থীরা পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে না।

সর্বশেষ খবর