বুধবার, ৩০ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা
শিক্ষা ও শিক্ষক

বিদেশি ভাষা শেখার গুরুত্ব অপরিসীম

বিদেশি ভাষা শেখার গুরুত্ব অপরিসীম

বিশ্বায়ন ও বিদেশি ভাষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলপ্রসূ যোগাযোগের ওপরই এখন সফলতা নির্ভরশীল। ইংরেজির পাশাপাশি অন্য কোনো বিদেশি ভাষার ওপর দখল থাকলে সহজেই লক্ষ্যে পৌঁছা যায়। তাই বিদেশি ভাষা শেখার নানাবিধ প্রয়োজনীয় দিক নিয়ে কথা বলেছেন দেশের প্রথম ফরাসি ভাষা শেখা বইয়ের লেখক এবং আলিয়ঁস ফ্রসেস দে ঢাকার শিক্ষক মোহাম্মদ আতাউর রহমান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফরাসি ভাষা শেখানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-শরীফ খান

 

প্রশ্ন : বিশ্বায়নের এই যুগে যোগাযোগ দক্ষতা আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিতে ইংরেজি ছাড়াও অন্যান্য ভাষা জানা লোকদের চাহিদা বাড়ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

উত্তর : এটি হচ্ছে সময়ের দাবি। শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাওয়ানো। বলা হয়ে থাকে Communication is power. আগে একটা সময় ছিল ইংরেজি জানা থাকলে ভালো চাকরি পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজির পাশাপাশি আরও দুয়েকটি বিদেশি ভাষা জানা আবশ্যক হয়ে পড়ছে। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য কোনো একটি এলাকা বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নিজেকে সমৃদ্ধ করতে এবং বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এর কোনো বিকল্প নেই। লক্ষণীয়, ভাষা শেখা বলতে এর listening, speaking, reading এবং  writing চারটি দক্ষতাই অর্জন করতে হবে।  দক্ষতা প্রমাণ করতে হলে এ চারটিরই অনুশীলন করতে হবে। তবেই ভাষাকে ব্যবহারিক প্রয়োজনে কাজে লাগানো যাবে।

প্রশ্ন : বর্তমান বিশ্বে ইংরেজি ছাড়া আর কোন কোন ভাষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি?

উত্তর : আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির পরেই হচ্ছে ফরাসি ভাষার স্থান। ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বললে ফরাসির পরে চাইনিজ ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বলা হয়ে থাকে ভবিষ্যৎ অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে চীন। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার চাকরির ক্ষেত্রে স্প্যানিশ ও আরবি ভাষার গুরুত্বও অপরিসীম। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ফরাসি ভাষার গুরুত্ব জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া ফরাসি ভাষা জানলে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষাও সহজে আয়ত্তে আনা যায়।

প্রশ্ন : বিশ্বায়নের এ যুগে যে কোনো বিদেশি ভাষা জানা লোকদের চাহিদা কেন বাড়ছে বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : বিশ্বায়ন ও ভাষা একটির সঙ্গে অপরটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ধরুন, একজন চাকরিপ্রার্থী যদি চারটি বিদেশি ভাষা জানেন তাহলে তিনি চারজন লোকের সমান মূল্যবান। বলা যায় একের ভিতরে চার। আমি দেখেছি, অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও ভালো চাকরি পাচ্ছে না। পক্ষান্তরে কোনো একটি বিদেশি ভাষায় দক্ষ একজন সহজেই পৌঁছতে পারছে তার গন্তব্যে। বিশ্বায়নের এ যুগে যোগ্যরাই টিকে থাকবে।

প্রশ্ন : বিদেশি ভাষা জানা শিক্ষার্থীদের চাকরি লাভের সম্ভাবনা কেমন?

উত্তর : অনেক বেশি। দেশের ভিতরে-বাইরে, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের চাকরিলাভের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কানাডায় ইমিগ্রেশন, দোভাষী এবং অনুবাদক হিসেবে, বায়িং হাউসে, বহুজাতিক কোম্পানিতে, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায়, ফাইভ স্টার হোটেল,  দূতাবাস, এনজিও, ট্যুরিস্ট-গাইড ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ রয়েছে। ভাষাশিক্ষা হচ্ছে একটি দক্ষতা আর যে কোনো দক্ষতাই হচ্ছে জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবহারিক প্রয়োজনেই ভাষা শেখা জরুরি।

প্রশ্ন : চাকরির ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া অর্থাৎ ক্যারিয়ার উন্নয়নে বিদেশি ভাষা জ্ঞান কতটা ভূমিকা রাখে?

উত্তর : চাকরির প্রতিযোগিতায় নিজের স্থান করে নেওয়া এবং এর উন্নয়নের জন্য বিদেশি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা দক্ষতা, যোগ্যতা ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ভাষা জানা ও এর সফল প্রয়োগে অন্যকে অনুপ্রাণিত করে দলকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি। সংক্ষেপে বলা যায়, ফলপ্রসূ ও ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের জন্য এটি অপরিহার্য।

প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন যে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের তাদের একাডেমিক বিষয়ের পাশাপাশি কোনো একটা বিদেশি ভাষা শিখে নেওয়া উচিত?

উত্তর : হ্যাঁ, আমি অবশ্যই বলবো। ছাত্রাবস্থায়ই কমপক্ষে একটি বিদেশি ভাষা শিখে নেওয়া উচিত। কারণ শেখার সময়তো এটাই। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে বয়স্কদের চেয়ে কম বয়সীরা ভালো করে থাকে। কারণ কর্মজীবী বা পেশাজীবীরা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। তাই আমার পরামর্শ, এখনই নিজেকে গড়ার উপযুক্ত সময় আর এই সময় ও সুযোগ সবারই কাজে লাগানো উচিত। তাছাড়া একটা ভাষাকে পেশাগত কাজে ব্যবহার উপযোগী করে শিখতে হলে অনেক সময় ও শ্রমের প্রয়োজন।

প্রশ্ন : জনপ্রিয় একজন শিক্ষক ও লেখক হিসেবে ফরাসি ভাষা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

উত্তর : চমৎকার ও দুর্লভ সব অনুভূতি রয়েছে। আমার প্রথম ফরাসি শেখার বই বের হওয়ার আগে অনুভূতি এমনটাই ছিল যেন আমি বাবা হচ্ছি। ফরাসি পৃথিবীর কঠিনতম ভাষার একটা। একজন শিক্ষককে তার শিক্ষার্থীর চাহিদা ও মানসিকতা বুঝতে হবে। আমি শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম বলেই এই পেশাকে অনেক বেশি উপভোগ করি।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে ফরাসি ভাষার শিক্ষা উপকরণ উন্নয়নে আপনি কী কী কাজ করেছেন?

উত্তর : সর্বস্তরের ফরাসি শিক্ষার্থীদের জন্য আমার লেখা বাংলা-ইংরেজি ফরাসি ভাষায় দেশের প্রথম বই যা শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাভাষী শিক্ষার্থীদের কাছে এ ভাষাকে আরও সহজভাবে উপস্থাপন করার জন্য কাজ করছি। ফরাসি অভিধান নিয়ে কাজ করছি। এক্ষেত্রে আমার শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ শাহ কোরেশীর অবদান অনেক। তাছাড়া বাংলা ভাষাও সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে কাজী নজরুল ইসলাম, হাসন রাজা, লালন শাহ, আব্দুল করিমের গানের অনুবাদ করছি। উল্লেখ্য, আমার লেখা বই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে খুবই জনপ্রিয়। কলকাতা, কানাডা, ফ্রান্সের বাঙালিদের কাছে এটিই একমাত্র নির্ভরযোগ্য ও পূর্ণাঙ্গ বই।

প্রশ্ন : বিদেশি ভাষা শেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের ঝোঁক বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি ভূমিকা কী হতে পারে?

উত্তর : বিদেশি ভাষা শেখার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবই ঢাকাতে। ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে জেলা শহরের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে। সবার আগে আমাদের প্রয়োজন দক্ষ প্রশিক্ষক। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেও ইংরেজি, আরবি ও চাইনিজ ভাষা প্রোগ্রাম চালু আছে।

পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার উপরও বিভিন্ন মেয়াদি কোর্স চালু করা যেতে পারে।

প্রশ্ন : বিভিন্ন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বিদেশি ভাষা শিক্ষা প্রোগ্রাম সম্পর্কে কিছু বলবেন?

উত্তর : ঢাকার অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ফরাসি, জার্মান, চাইনিজ ও স্প্যানিশ ভাষা শেখানো হচ্ছে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অনেক স্কুলেই বাধ্যতামূলক। অনেক শিক্ষার্থী ‘ও’ লেভেল পরীক্ষায় ফরাসি ভাষায় ভালো ফলাফল করছে। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ও শিক্ষাবৃত্তির জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে যোগ্য, দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম।

প্রশ্ন : ফরাসি ভাষা শেখা ও শেখানোর পেছনে আপনার মোটিভেশন কী?

উত্তর : দেখুন আমি সব সময় চেয়েছি দেশের জন্য কিছু করা; তরুণদের ভাষা শিক্ষা দিয়ে তাদের জনসম্পদে পরিণত করা।  বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বিদেশি ভাষায় দক্ষতা বাড়াতে হবে কারণ এর গুরুত্ব অপরিসীম। কারিগরি জ্ঞান, দক্ষতা ও ভাষাগত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে জনশক্তি হতে পারে জনসম্পদ। বিশ্বায়নের এ যুগে পুঁথিগত বিদ্যার প্রয়োজন প্রায় সীমিত। মোটিভেশন হচ্ছে ইন্টারনাল এবং এক্সটারনাল। আমার ক্ষেত্রে প্রথমটাই কাজ করেছিল।

প্রশ্ন : ফরাসি ভাষার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?

উত্তর : শৈশব থেকে ইংরেজি চর্চা শুরু করলেও আমাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী যথাযথভাবে তা বলতে, লিখতে ও পড়তে পারে না। দীর্ঘদিন ইংরেজি চর্চা করেও যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে অন্য কোনো একটি ভাষায় দক্ষতা আনতে হলে সংক্ষিপ্ত সময় বা নির্দিষ্ট কোনো কোর্স অবশ্যই যথেষ্ট নয়। একটি দুটি কোর্স করে আসলে ফরাসি, জাপানিজ, চীনাসহ কোনো ভাষা-ই শেখা সম্ভব না।  শুধু শখের বশে ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হয়ে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। এজন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, ইচ্ছা ও অধ্যবসায়। নিয়মিত ক্লাস করার পাশাপাশি বাসায়ও রুটিন করে পড়াশোনা করতে হবে। বিরতি দিয়ে পড়াশোনা করে কোনো বিদেশি ভাষায় দক্ষতা আনা সম্ভব না। এজন্য নিয়মিত চর্চা করতে হবে যা কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, ভাষা হচ্ছে একটি দক্ষতা। অন্য যেকোনো কিছু শেখার মতো ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও শ্রম এবং কৌশল প্রয়োগ জরুরি। অনুবাদের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ফরাসিসহ যে কোনো ভাষা কমিউনিকেটিভ উপায়ে শিখতে হবে। ভাষা শেখার সনাতন পদ্ধতি পরিহার করতে হবে। বাংলার সঙ্গে ফরাসির অনেক মিল আছে। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষার উপরও ভালো দখল থাকা আবশ্যক।

সর্বশেষ খবর