বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
শিক্ষকের কথা

শিক্ষকরাই মানসম্মত শিক্ষাদানের প্রধান হাতিয়ার

শিক্ষকরাই মানসম্মত শিক্ষাদানের প্রধান হাতিয়ার

উচ্চ মাধ্যমিকের পাশাপাশি অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম রয়েছে দেশের এমন ৬৮৫টি কলেজের উপর প্রথমবারের মতো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটি র্যাংকিংস করেছে।  এতে খুলনা বিভাগে সেরা ১০টি কলেজের একটি হচ্ছে যশোর সরকারি এমএম কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির এ সফলতার পেছনে কারণ কী, শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নে করণীয় কী, প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রস্তুত হতে হবে এবং শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন কলেজটির অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মিজানুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন  নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর—সাইফুল ইসলাম।

 

প্রশ্ন : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো দেশের সব কলেজ র্যাংকিংস প্রকাশ করেছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

অধ্যক্ষ : এটা একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলেই আমি মনে করি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে, এতদিন সেটার মূল্যায়নের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এই পদক্ষেপের ফলে সেই মূল্যায়নটা এখন করা যাচ্ছে। তাই এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।

প্রশ্ন : কলেজ র্যাংকিংয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে আপনার প্রতিষ্ঠান সেরা ১০টির একটি। এই সফলতার পেছনে কোন কোন বিষয় ভূমিকা রেখেছে বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যক্ষ : আমরা দৈনন্দিন লেখাপড়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি। পাঠদান কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য উপাধ্যক্ষের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদারকি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো ক্লাসে উপস্থিত হচ্ছে কি না, সিডিউল ক্লাসগুলো শিক্ষকরা ঠিকমতো নিচ্ছেন কি না, ড্রপআউটের সংখ্যা কেমন হচ্ছে, এসব বিষয় ওই কমিটি দেখভাল করে। এছাড়া প্রগ্রেস রিপোর্ট নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গেও আমরা নিয়মিত কথা বলি। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষে যাতে ঠিকমতো পাঠদান করানো হয়, সে জন্য শিক্ষকদের সঙ্গেও আমরা নিয়মিত বৈঠক করি। এসব বিষয়ের কারণেই আমাদের কলেজ র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থানে থাকতে পেরেছে বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন : বিগত বছরগুলোয় বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে আপনার প্রতিষ্ঠানের সাফল্য কেমন?

অধ্যক্ষ : পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল আমাদের কলেজে বরাবরই ভালো হয়। গতবার এইচএসসির ফল কিছুটা খারাপ হয়েছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এ ব্যাপারে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছি। আমাদের মতো একটি কলেজে সরকার মাসে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। সেখানে মাত্র ২০ টাকা বেতন দিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে এসব শিক্ষার্থী। এক এক শিক্ষার্থীর পেছনে সরকার প্রচুর টাকা খরচ করছে। ফলে এখানকার শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ঠিকমতো লেখাপড়া করতে হবে। আমি বলে দিয়েছি, যারা ঠিকমতো লেখাপড়া করবে, তাদের সর্বোচ্চ বেনিফিট দেওয়া হবে, যারা অবাধ্য হবে, তাদের টিসি দিয়ে দেওয়া হবে।

 

প্রশ্ন : দেশের শিক্ষার গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন আছে। মান বাড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট সবার করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যক্ষ : আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের যুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে, তাদের গুণগত মানোন্নয়নে বিতর্ক প্রতিযোগিতা চালু রেখেছি। এই প্রতিযোগিতা আন্তঃডিপার্টমেন্ট ও আন্তঃকলেজ পর্যায়ে হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্টে পত্রপত্রিকা, জার্নালসহ সৃজনশীল যা কিছু দরকার দেওয়া হচ্ছে। মাল্টিমিডিয়া সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। ২০টি ডিপার্টমেন্টে ২০টি প্রজেক্টর সংযোজন করা হয়েছে। শিক্ষকদের ইনহাউজ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেখানে সৃজনশীল ট্রেনিংয়ের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছি আমরা। এছাড়া কলেজে মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করছি যাতে ক্যাম্পাসে আসলেই যেন শিক্ষার্থীদের মন ভালো হয়ে যায়, শিক্ষা গ্রহণের জন্য তাদের মন তৈরি হয়ে যায়।

প্রশ্ন : শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা কী?

অধ্যক্ষ : এক্ষেত্রে শিক্ষকদের ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা দেওয়ার প্রধান হাতিয়ারই হলেন শিক্ষক। তারা মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকরা শিল্পীর মতো শিক্ষার্থীদের ভিতরে ঢুকে তাদের অন্তরকে বিকশিত করবেন।

প্রশ্ন : মূল্যবোধের অবক্ষয় এখন সমাজের সর্বস্তরে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর উন্নয়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন? আপনার প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?

অধ্যক্ষ : ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত কোনো সরকারই দেশে শিক্ষানীতি দিতে পারেনি। এখন একটা শিক্ষানীতি হয়েছে। সামান্য সমস্যা থাকলেও তা ভালো। একমুখী শিক্ষা চালু করতে পারলে আরও ভালো হতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তদারকির ব্যবস্থা আরও জোরদার করা দরকার। শিক্ষানীতি তৃণমূল পর্যন্ত বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা খেয়াল করতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের মতামত নিতে হবে। আর মূল্যবোধ তৈরির জন্য যে শিক্ষা বা চর্চা দরকার তা তো হয়নি। এতদিন আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে পারিনি। সে কারণে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেশপ্রেম, দেশের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা তৈরি হয়নি। কর্তব্য না করলে অধিকার তৈরি হয় না।  পয়লা বৈশাখের মতো অসাম্প্রদায়িক উৎসবগুলো বেশি বেশি করে চর্চা করতে হবে, যেখাবে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। এসবের মাধ্যমেই মানুষের মূল্যবোধ বিকশিত হবে।

প্রশ্ন : সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে?

অধ্যক্ষ : শিক্ষার্থীদের শুধু একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করে পাশাপাশি দেশজ ঐতিহ্য, রাজনৈতিক, সামাজিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে শিক্ষার্থীদের বিকশিত করতে হবে। এগুলো না করা হলে শিক্ষার্থীরা খাপছাড়া হয়ে বেড়ে উঠবে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা—এ ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমের কোনোটিই অনর্থ নয়। শিক্ষার্থীদের এসব জীবনঘনিষ্ঠ কার্যক্রমে জড়াতে হবে। খেলাধুলায় যারা ইতিমধ্যেই দেশ-বিদেশে তারকায় পরিণত হয়েছে, তাদের আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের সংস্পর্শে আনছি, যাতে তাদের দেখে আমাদের শিক্ষার্থীদের মনেও তারকায় পরিণত হওয়ার উচ্চাশা তৈরি হয়।

প্রশ্ন : আপনার শিক্ষাজীবনের কোনো মধুর স্মৃতি থাকলে বলুন।

অধ্যক্ষ : মধুর স্মৃতি তো অনেক আছে। আমার ছাত্রদের মধ্যে এখন কেউ সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি, কেউ ইউএনও, কেউ কেউ আবার বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি, বায়িং হাউসের মালিক। আবার কেউ এখন আমারই সঙ্গে শিক্ষকতা করছে। তারা যখন ফোন দেয়, কথা বলে, স্মরণ করে তখন ভালো লাগে।

প্রশ্ন : স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আপনার উপদেশ কী?

অধ্যক্ষ : শিক্ষার্থীদের বড় হওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা থাকতে হবে। অসম্ভব বলে কিছু নেই। স্বপ্ন থাকতে হবে, স্বপ্ন পূরণের প্রতিজ্ঞা করতে হবে। সে অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে একাগ্রচিত্তে সাধনা করতে হবে। একাগ্রচিত্তে সাধনা ছাড়া ফলবর্তী হওয়া যায় না। একাগ্রচিত্তে সাধনা করলে সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আশা পূরণ করবেন। আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবে, যে কাজের নৈতিক ভিত্তি নেই, সেটা আসলে কোনো শুভ কাজ হতে পারে না। সেই কাজ কোনো শুভ ফল বয়ে আনতে পারে না।

সর্বশেষ খবর