রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশে করণীয়

দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো খুবই জরুরি। তবে দেশের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশ ও জাতি গভীর সামাজিক সংকটের মুখে পড়তে পারে। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজের করণীয় কী এ ব্যাপারে মূল্যবান মতামত দিয়েছেন দেশের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা।

“ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই”

নুরুল ইসলাম নাহিদ

শিক্ষামন্ত্রী

শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলি গড়ে তুলতে পরিবারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ পরিবারেই এসবের বীজ প্রোথিত হয়। এছাড়া সামাজিক পরিবেশ দেখে শিশুরা অনেক কিছু শেখে। এজন্য সমাজকে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। সামাজিক কৃষ্টি-কালচার, রীতি-নীতিও শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলে। তাই প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সকল স্তরে নিয়মিত দেশের কৃষ্টি-কালচারবিষয়ক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটি শক্ত ভিত গড়ে উঠবে। ফলে তারা বিপথগামী হওয়া থেকে বিরত থাকবে। সেইসঙ্গে তাদের মননশীলতার বিকাশ ঘটবে। এছাড়া মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। ধর্মের প্রকৃত পাঠই শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে ধর্মের অপব্যাখা দিয়ে কেউ যাতে শিক্ষার্থীদের ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।  

 

“শিক্ষার্থীদের নৈতিক বিকাশ পরিচর্যার উপর নির্ভরশীল”

ব্রিগে. জেনারেল এম এম সালেহিন

অধ্যক্ষ, রাউজক উত্তরা মডেল কলেজ

শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশের বিষয়টি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের ত্রিভুজ সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের একটি ‘বৃক্ষ’ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, যার সুন্দর ও যথাযথভাবে বেড়ে উঠা নির্ভর করে পরিচর্যার ওপর। পরিচর্যা যেমন হবে তার বেড়ে উঠাও তেমন হবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের সুন্দরভাবে বিকাশের বিষয়টি তাদের যথাযথভাবে দেখাশোনা এবং পরিচর্যার ওপর নির্ভরশীল। ‘রাউজক উত্তরা মডেল কলেজ’ শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশে সচেষ্ট। এই কলেজের মোটো হচ্ছে ‘মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা’। আমরা শিক্ষার্থীদের শুধু জ্ঞানার্জন নয়, মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়ে থাকি। এজন্য আমাদের ‘সোশ্যাল সার্ভিসেস ক্লাব’ রয়েছে যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নানামুখী সামাজিক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করানো হয়। এতে তাদের ভিতর সামাজিক দায়িত্ববোধ গড়ে উঠছে। পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ততটা হয় না। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে পারিপার্শ্বিক অবস্থা। শিক্ষার্থীরা তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকেই মূলত নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির শিক্ষা পায়। পরিবারের ভূমিকা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। আর নৈতিক গুণাবলির বিকাশের ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের চারপাশটা কেমন তা গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল সমাজে নেতিবাচক বিষয়গুলোর প্রভাব খুব বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এজন্য ‘কাউন্টার ইনিশিয়েটিভ’ নিতে হবে। যেহেতু নৈতিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে মূলত পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে তাই এক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাইকে সমভাবে ভূমিকা রাখতে হবে।

 

“শুধু শিক্ষা নয়, চাই সুশিক্ষা”

কর্নেল নূরন্ নবী (অব.) সাবেক প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, মাইলস্টোন কলেজ এবং রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ।

‘যদি তুমি এক বছরের পরিকল্পনা মতো ফল পেতে চাও তবে শস্য রোপণ কর, যদি দশকের পরিকল্পনায় ফল পেতে চাও তবে বৃক্ষরোপণ কর আর যদি সারা জীবনের জন্য পরিকল্পনা করে ফল পেতে চাও তবে মানুষের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা কর।’ এটি দার্শনিক কুয়ানত্সুর মত। বস্তুত এই সুশিক্ষা শব্দটির মধ্যেই সব প্রশ্ন ও প্রশ্নের উত্তর সন্নিবেশিত থাকছে। আমরা নৈতিক শিক্ষার কথাই বলি বা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার কথাই বলি সবকিছুর একটা সহজ মেলবন্ধন হবে সুশিক্ষা। বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট নৈতিক এবং মানবিক শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে আমাদের আরেকবার ভাবতে বাধ্য করেছে। শুধু শিক্ষা নয়, চাই সুশিক্ষা। যে শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক মানদণ্ডকে উন্নত করার পাশাপাশি তার ভিতরকার মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখবে।  শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবক সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে করে ক্লাসের শিক্ষা শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ও সৃজনশীল চিন্তার প্রসার ঘটাতে পারে। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বা স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা বাধাগ্রস্ত হয় এমন কিছু করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, জীবনের শুরুতে চিন্তা-চেতনার স্বাভাবিক ধারা বাধাগ্রস্ত হলে তা থেকে বৈপরীত্য জন্ম নেয়। এ ধরনের পন্থা কখনো আদর্শিক নয় বরং সাংঘর্ষিক হয়। সুতরাং সন্তানের কোমল চিন্তা-চেতনাকে লালন করতে হবে এবং এর বিকাশে আমাদের ভূমিকা হবে সার্বক্ষণিক সহায়ক।

প্রতিটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো তার পরিবার। যেখানে বাবা, মা, পরিবার-পরিজনের প্রত্যেক সদস্যই শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। জীবনযাপনের দায়ে আমাদের সকাল শুরু হয় ব্যস্ততা দিয়ে আর রাত আসে ক্লান্তি নিয়ে তবুও সবকিছুর ডামাডোলে আপনার সন্তানকে কখনোই আড়াল করতে যাবেন না। অনেক সময় না হোক, অল্প সময় নিয়ে হলেও প্রত্যেকদিন সন্তানের খোঁজখবর রাখতে হবে অন্যথায় আপনার সব কষ্টার্জিত সফলতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

অভিভাবক হিসেবে মাঝেমধ্যে আন্তরিকতা নিয়ে সন্তানের পাশে বসুন। শাসন, হাপিত্যেশ, চাওয়া পাওয়া বা অভাব অভিযোগ নয় বরং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলাপ করুন। সে কী চায়, কীভাবে চায়, কেন চায় তা জানার পাশাপাশি এর ধরন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করুন। ব্যাপক অর্থে সন্তানকে জানুন এবং তাকে জানান— মানুষের মতো মানুষ হওয়ার কথা, মূল্যবোধের কথা,  ইতিহাস ঐতিহ্য, শিল্পিত সংস্কৃতিবোধ এবং আমদের গর্ব মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা।  আলোয় ভরা ভবিষ্যৎ মানে আমাদের সন্তান। সমৃদ্ধ দেশ, সুন্দর বিশ্ব মানে আমাদের সন্তান। আসুন, সুন্দর মানবিক জীবন গড়তে আমরা সন্তানদের পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকব।

 

“শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে”

লে. কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দিন, পদাতিক

অধ্যক্ষ, মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, ঢাকা।

প্রথমত পরিবার হচ্ছে এক্ষেত্রে প্রথম ও প্রারম্ভিক ক্ষেত্র। একটি শিশু তার জীবনের শুরুর দিকে পরিবার থেকেই জীবন চলার পথের শিক্ষা পেয়ে থাকে। পরিবারে মা-বাবা বা অভিভাবক এবং নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে তারা নৈতিক শিক্ষা পায়। তাই শিশুদের নৈতিকভাবে বিকশিত করতে হলে পরিবারের সদস্যদের এক্ষেত্রে নৈতিক গুণাবলি ধারণ করতে হবে। আর শিশুরা যখন বড় হতে থাকে তখন তারা সমাজ বা চারপাশ থেকে অনেক কিছু শিখে থাকে। তাই শিশুরা যে সমাজ বা পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বড় হচ্ছে সেখানেও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ বিদ্যমান থাকতে হবে। এতে শিশুরা সুন্দর ও আদব-কায়দার সঙ্গে বেড়ে ওঠার দিক-নির্দেশনা পায়। শিশুদের মাঝে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশের তৃতীয় ক্ষেত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানেই তারা পরিবার থেকে প্রাপ্ত নৈতিক শিক্ষার বিকাশের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক গুণাবলির শিক্ষা পেয়ে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানান পরিবারের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মেশার সুযোগ হয়। এ মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক বিষয় বুঝতে ও জানতে শিখে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছেলেমেয়েরা কোনো বিষয়ে হয়তো বাবা-মা’র কথা শুনছে না। কিন্তু শিক্ষকের কথা শুনছে। তাই শিক্ষার্থীদের নৈতিক, সামাজিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হলে প্রথমে শিক্ষকদের ভিতর এগুলো ধারণ করতে হবে। বাবা-মা’র পর ছেলেমেয়েরা শিক্ষকদেরই তাদের জীবন চলার পথের কাণ্ডারি বিবেচনা করে।

 

“শিক্ষকরাই মানুষ গড়ার কারিগর”

মুহম্মদ আবুল কালাম আজাদ

চেয়ারম্যান, রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিমাণগত শিক্ষার লক্ষ্য পূর্ণ হলেও ঘাটতি রয়েছে গুণগত শিক্ষায়। কোমলমতি শিশুদের মননে শৈশব থেকেই জাগ্রত করতে হবে নৈতিকতাবোধ। এই শিক্ষা পরিবার থেকে শুরু হবে আর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিবেন শিক্ষকরা। পরিবারের সবাইকে ছেলেমেয়েদের বেড়ে উঠার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আর এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন মা। শিশুরা যখন বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করবে তখন থেকে তারা পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে চলে আসবে। শিক্ষকরা তাদের অভিভাবক হিসেবে সততা, দায়িত্ববোধ, স্বচ্ছতা, নৈতিকতা শিক্ষা দিবেন। তাদের শেখাতে হবে সততাই সর্বোত্কৃষ্ট পন্থা, গুরুজনে কর নতি। বড়দের সম্মান করা অথবা ছোটদের স্নেহ করা এই মানবীয় দিকগুলো স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে তাদের পাঠ্যক্রমে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত করলে এই সমাজ, মানুষ, পৃথিবী নিয়ে তাদের কোনো সম্যক ধারণা থাকবে না। তাই তাদেরকে পাঠ্যবইয়ের বাইরে গল্পের বই, কবিতা, উপন্যাসের সঙ্গে পরিচিত করাতে হবে। শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার বড় দায়িত্ব শিক্ষকদের কাঁধে। কারণ তারা মানুষ গড়ার কারিগর। তবে এই প্রজন্মের কিছু শিক্ষকের মধ্যে দুর্নীতি, অসততা ঢুকে গেছে। কিন্তু তাই বলে পুরো শিক্ষক সমাজকে কালিমালেপন করা যাবে না। শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির ভালো-মন্দ ব্যবহার এবং প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করে দিকনির্দেশনা দিতে হবে শিক্ষকদের। সর্বোপরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতে হবে শিক্ষার্থীদের মানসে। আর এটা কারও একার নয়, বরং সবার দায়িত্ব। সরকার, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পরিবার এবং সমাজের মানুষকে একত্রিত হয়ে সমকালীন বিষয়গুলো মোকাবিলা করতে হবে।

 

 

“পরিবার হচ্ছে মানবিক গুণাবলি অর্জনের প্রথম শিক্ষাগার”

মো. ফরহাদ হোসেন, অধ্যক্ষ

মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা

পৌরনীতির ভাষায় ‘পরিবারকে বলা হয় মানবিক গুণাবলি অর্জনের প্রথম শিক্ষাগার’। যেখানে একজন ছেলে বা মেয়ে বড়দের শ্রদ্ধা করা ও ছোটদের স্নেহ করার শিক্ষা পায়। পরিবারই হচ্ছে এক্ষেত্রে প্রথম ধাপ। বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় পরিবারের গণ্ডির বাইরে ছেলে-মেয়েরা যখন তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে মিশে তখন তারা আরও বেশি শেখার সুযোগ পায়। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে শিশুরা নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশে। এর ফলে অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্যদিয়ে তাদের মধ্যে নানা নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে। এরপর তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় যা নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের অনেক একটা পরিধি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি গণ্ডির মধ্যে হলেও শিক্ষার্থীরা এখান থেকেই জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা পায় কারণ শিক্ষকরা জীবনের নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শেখানোর ও বোঝানোর চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা, সমাজের প্রতি দায়িত্ব্-কর্তব্য কী তা তাদের জানানো-শেখানো সর্বোপরি মানুষ গড়ার কারিগর কিন্তু শিক্ষকরাই। অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মার কথা হয়তো শিক্ষার্থীরা শুনছেন না কিন্তু একজন শিক্ষকের কথার প্রতি তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই বড় ভূমিকা পালন করছেন।

 

 

“পরিবারই শিশুর প্রথম পাঠশালা”

 অধ্যাপক আবদুল মান্নান

চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

পারিবারিক বন্ধনই নৈতিকতা ও মূল্যবোধ গড়ে তুলতে পারে। সমাজে পারিবারিক বন্ধনগুলো এখন আর আগের মতো দেখা যায় না। পরিবারগুলোও আর আগের মতো দায়িত্ব পালন করে না। এক্ষেত্রে পরিবার থেকে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের পাঠ পাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে যায়। পরিবারই শিশুর প্রথম পাঠশালা। বাবা-মা-ই প্রথম শিক্ষক। এদের কাছ থেকেই শিশুরা প্রাথমিক পাঠ পেয়ে থাকে। কিন্তু পরিবারে পাঠ না পেলে মূল্যবোধ গড়ে উঠে না। সমাজে আজ আদর্শ ব্যক্তির অভাব। এখন বিত্তবানরাই আদর্শ হয়ে উঠেছে। আর পেশিশক্তির অধিকারীরা হয়ে উঠেছে সমাজপতি। অনেক শিক্ষকও হয়ে পড়েছেন বাণিজ্যমুখী। ক্লাসের থেকে কোচিং-প্রাইভেটে বেশি সময় দেন কেউ কেউ। সহশিক্ষা কার্যক্রমের পথগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বিদ্যা আজ বাক্সবন্দী হয়ে পড়েছে। পড়াশোনা হয়ে উঠেছে পরীক্ষামুখী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের উদার, চিন্তা-ভাবনামুখী করতে পারেনি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সে জন্য গ্রহণ করতে হবে সমাজ ও মানবকল্যাণমুখী নানা পদক্ষেপ।

 

“শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন”

হামিদা আলী, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ

সাউথপয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা

জন্মের পর থেকেই প্রতিটি শিশুর মাঝে নানাভাবে মানবিক ও নৈতিক গুণাবলির বিকাশ ঘটতে থাকে। এক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উভয়ই ভূমিকা রাখে। প্রথমত. পরিবার হলো শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক গুণাবলির বিকাশের প্রধান ও প্রাথমিক মাধ্যম। পরিবারে প্রতিটি মা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদেরও ভূমিকা রাখতে হবে কারণ ছেলেমেয়েরা তাদের শৈশবকালে বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেই নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার ভিত্তি পেয়ে থাকেন। শৈশবে শেখা মূল্যবোধই প্রতিটি শিশু তাদের পরবর্তী জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে নানাভাবে বিকাশ ও পরিচর্যা করে থাকে। সে জন্য খোদ বাবা-মা ও নিকটাত্মীয়দেরও নৈতিক গুণাবলি ধারণ করতে হবে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মাঝে সামগ্রিক গুণাবলির বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কারণ শিক্ষকদের কাছ থেকেই শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ পথচলার নির্দেশনা পায়। তাই শিক্ষকদের এক্ষেত্রে অবশ্যই ভূমিকা রাখতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের নৈতিক এবং মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন হতে হবে কারণ তাদের দেখেই তো ছেলেমেয়েরা শিখে থাকে।

 

“মা-বাবার পরই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের স্থান দেয়”

প্রফেসর শাহেদা ইসলাম, চেয়ারম্যান

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, চট্টগ্রাম

মা-বাবা বা অভিভাবকের পরই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের স্থান দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের এ বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। পরিবারের বাইরে শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই নৈতিক ও সামাজিক গুণাবলির শিক্ষা পেয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো, তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করা ও দেশপ্রেমে জাগ্রত করার কাজটি কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই করে থাকে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মনের জানালা খুলে দিতে হবে যাতে ঠিকমতো তাতে আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে। এক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব শিক্ষকদেরই নিতে হবে। তাদেরও নৈতিক গুণাবলির অধিকারী হতে হবে। বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে দেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের এই সংকটকালে শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক গুণাবলির বিকাশ এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

 

“শিক্ষার্থীর মনে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে”

রাশেদা আক্তার, প্রধান শিক্ষক

কুমিল্লা জিলা স্কুল

শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলির বিকাশে প্রথমে পরিবার থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। তাই মা-বাবা দুজনকে সন্তানদের গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের নৈতিক আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মনের ভিতরে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। দেশপ্রেমিক নাগরিক কখনো জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে না। স্কুলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের আদর্শ বলে ধরে নেয়। তারা শিক্ষকদের অনুসরণ করে থাকে। শিক্ষকের সঠিক নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। শিক্ষকদের নিজেদের আদর্শবান হতে হবে, নতুবা শিক্ষার্থীরা তাদের উপদেশ পালন করবে না। ঘরে অভিভাবক আর স্কুলে শিক্ষক সঠিক নজরদারি করলে শিক্ষার্থীদের বিপথে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সর্বশেষ খবর