সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ভিসির চোখে

সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতিই একবিংশ শতাব্দীতে অর্থনৈতিক মুক্তির পথনির্দেশক

সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতিই একবিংশ শতাব্দীতে অর্থনৈতিক মুক্তির পথনির্দেশক

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সমুদ্র ও সমুদ্র সম্পদের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে সরকার ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ নামে দেশের প্রথম মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে। দেশের প্রথম ও একমাত্র এই মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির ভিসির দায়িত্বে আছেন রিয়ার এডমিরাল এ এস এম আবদুল বাতেন, বিএসপি, এনডিসি, পিএসসি। দেশে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা, এর বর্তমান শিক্ষা কার্যক্রম, পূর্ণাঙ্গভাবে চালুর লক্ষ্যে ক্যাম্পাস, অবকাঠামো ও কোর্স কারিকুলাম উন্নয়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জসমূহ, মেরিটাইম বিষয়ে দক্ষ জনসম্পদ তৈরি এবং দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি কীভাবে ভূমিকা রাখবে এসব নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. শরীফ খান।

 

প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য কী? দেশে সমুদ্রবিষয়ক উচ্চশিক্ষার এটাই তো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম প্রতিষ্ঠান? স্থায়ী ক্যাম্পাস কোথায় হচ্ছে?

উপাচার্য : আপনারা জানেন, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক স্বপ্ন ছিল। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী মেরিটাইম দেশ হিসেবে বিশ্বের মাঝে তুলে ধরবেন। সেই লক্ষ্যে তিনি এ অঞ্চলের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেশের নিজস্ব সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেন ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ জারির মাধ্যমে। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় মেরিটাইম বিষয়ে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১৫ সালের আগস্ট মাস থেকে আমরা মিরপুরের পল্লবীতে একটি ভবনে অস্থায়ীভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছি। সবার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম জেলার বন্দর থানার ৫নং মোহরা ওয়ার্ডের হামিদচর এলাকায় চর রাঙামাটিয়া ও বাকলিয়া মৌজায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন ১০০ একর জমি সরকার অনুমোদন দিয়েছে। জমিটি অধিগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। সার্বিকভাবে আশা করা যায় যে, ২০২১ সাল নাগাদ প্রস্তাবিত ৭টি ফ্যাকাল্টি ও ৩৮টি বিভাগ নিয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চালু করতে আমরা সক্ষম হব।

প্রশ্ন : সরকার দেশে একটি মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা কেন অনুভব করেছে বলে আপনি মনে করেন?

উপাচার্য : আপনারা সবাই জানেন যে, আমাদের দেশ একটি ছোট দেশ এবং এর আয়তন জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম। আমাদের স্থলসম্পদও সীমিত কিন্তু এ দেশের প্রায় সমান আয়তনের এলাকা আমাদের রয়েছে বঙ্গোপসাগরে। সমুদ্র সম্পদের গুরুত্ব অনুধাবন করে এই সম্পদ আহরণের লক্ষ্যে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালানোর জন্য আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার ২০০২ সালে এবং ভারত ২০০৮ সালে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং ক্রমশ সীমিত হয়ে আসা স্থলসম্পদের কারণে আমাদের জন্য সমুদ্র সম্পদের আহরণ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। কিন্তু এজন্য আমাদের দক্ষ জনবল নেই। তাই সমুদ্র বক্ষে লুকায়িত প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, আহরণ এবং সমুদ্রনির্ভর যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নতির বিষয়ে এ প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ২০২১ সালের মধ্যে সমুদ্রবিষয়ক একাডেমিক ও পেশাগত শিক্ষার বিশ্বমানের একটি ক্যাম্পাসে পরিণত করা আপনাদের ভিশন। তা কীভাবে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা নিয়েছেন?

উপাচার্য : বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত জায়গাটি এখনো হস্তান্তর সম্পন্ন হয়নি, যার ফলে সার্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরুতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের খসড়া ডিপিপি (Development Project Proposal) প্রণয়ন করেছি যা অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে। খসড়া ডিপিপিতে বিশ্বমানের ক্যাম্পাসের আধুনিক সুবিধাসংবলিত একাডেমিক ও প্রশাসনিকসহ ভবন, আবাসিক হল, মেরিন একুরিয়াম, রিসার্চ ল্যাবরেটরি, ডিজিটাল লাইব্রেরি, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, স্টেডিয়াম, শিপ মডেল টেস্টিং ল্যাব, হাইড্রোডাইনামিক ল্যাব ইত্যাদি পর্যায়ক্রমিকভাবে স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সুইডেনের ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, চীনের সাংহাই এবং ডালিয়ান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, মিয়ানমার মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছি। এছাড়াও জাপানের ওসাকা ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়ার পূত্রা ও তেরেঙ্গানু ইউনিভার্সিটিসহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, আধুনিক প্রযুক্তি, ছাত্রছাত্রী বিনিময়ের মতো বিষয়ে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও বর্তমানে ডালিয়ান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ প্রফেসর পিকে মুখার্জি কর্তৃক একটি কোর্স পরিচালনা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও বিদেশি বিশেষজ্ঞ শিক্ষক দ্বারা বিভিন্ন কোর্স পরিচালনা করা হবে। ইতিমধ্যে জাপান, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ভারত. যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশকিছু দেশের প্রতিনিধি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন এবং তারা একযোগে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও ভবিষ্যতে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও মেরিটাইম বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনে আসবে বলে আমি আশাবাদী। এরকমই একটি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার পরিবেশ আমরা এখানে গড়ে তুলতে চাই। আশা করি ২০২১ সালের মধ্যে আমরা সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে সক্ষম হব।

প্রশ্ন : সমুদ্র ব্যবস্থাপনা, সামুদ্রিক বাণিজ্যের সুবিধাদি গ্রহণ ও কৌশলগত দিক উন্নয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন?

উপাচার্য : মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দেশে এতদিন উচ্চশিক্ষার বিশেষ করে গবেষণানির্ভর উচ্চশিক্ষার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আপামর জনসাধারণের জন্য সেই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হলো মেরিটাইমবিষয়ক উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও বহিরাঙ্গন কার্যক্রমকে বিশ্বমানে এগিয়ে নেওয়া এবং এর উৎকর্ষ সাধন করা। এ বিষয়ে আমাদের মাস্টার্স প্রোগ্রাম দুটি [এলএলএম ইন মেরিটাইম ল’ এবং মাস্টার্স ইন পোর্ট অ্যান্ড শিপিং ম্যানেজমেন্ট] বেশ সাড়া পেয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে মেরিটাইম সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করা হবে। এছাড়া আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে ওশানোগ্রাফি, নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর/ওশান ইঞ্জিনিয়ারিং, মাইনিং, মেরিটাইম সিকিউরিটি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড নটিক্যাল সায়েন্স, বায়োটেকনোলজি, বায়ো-ডাইভারসিটি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি বিষয়েও উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। সারকথা হলো অদূর ভবিষ্যতে মেরিটাইম শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি উৎকর্ষতার কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত করার জন্য আমরা বদ্ধপরিকর।

প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে কাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে?

উপাচার্য : বিশ্ববিদ্যালয় আইনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষাদান উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে যোগ্যতা পূরণ সাপেক্ষে যে কোনো ব্যক্তি এখানে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবেন। এ বিশ্ববিদ্যলয় স্থাপনের মাধ্যমে দেশে মেরিটাইম বিষয়সমূহে শিক্ষা গ্রহণের এবং চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

 

প্রশ্ন : এখানে পড়াশোনার গড়পড়তা খরচ কেমন? শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো ধরনের বৃত্তির সুযোগ রয়েছে কী?

উপাচার্য : এটি একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় এবং আপনারা হয়তো জানেন যে দেশে মেরিটাইম বিষয়ে পাঠদানের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নেই। সেজন্য আমাদের বিদেশ থেকেও শিক্ষক এনে পাঠদান করতে হচ্ছে। যা হোক, আমরা সার্বিকভাবে চেষ্টা করেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যতটা সম্ভব কম রাখার জন্য। বর্তমানে একটি দুই বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রাম শেষ করতে একজন শিক্ষার্থীর আনুমানিক এক লাখ আশি হাজার টাকা খরচ পড়ে। তবে মেধাবী ও গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।

প্রশ্ন : মেরিটাইম ডিগ্রিধারীদের দেশে-বিদেশে চাকরির সুযোগ কেমন?

উপাচার্য : মেরিটাইম ডিগ্রিধারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ রয়েছে। যেমন বিচার বিভাগ (মেরিটাইম ‘ল’ সংক্রান্ত), সমুদ্র বন্দর, শিপিং কোম্পানি, মেরিটাইম রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে তারা কাজ করতে পারবে। অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও শিল্পে কাজ করে তারা দেশকে ব্লু-ইকোনমিতে উত্তরণে সহায়তা করবে। এছাড়া তারা প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দেশে-বিদেশে চাকরির সুযোগ পাবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

সর্বশেষ খবর