শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী প্রস্তুতি বাংলা

মেহেরুন্নেসা খাতুন, সিনিয়র শিক্ষিকা

রচনা লিখন

প্রশ্নে চারটি বিষয় সম্পর্কে রচনা দেওয়া থাকবে। এর মধ্যে একটি বিষয়ে ২০০ শব্দের মধ্যে রচনা লিখতে হবে। প্রশ্নের প্রতিটি রচনার সঙ্গে ইঙ্গিত বা উপশিরোনাম দেওয়া থাকবে—

রচনার বিষয়বস্তু বই থেকেই আসবে। গদ্যের পাশাপাশি কবিতার বিষয়বস্তু থেকেও কবিতা আসতে পারে। এ অংশে ভালো নম্বর পেতে হলে ভূমিকা থেকে উপসংহার পর্যন্ত পুরো অংশ লিখতে হবে।

 

কম্পিউটার

ভূমিকা : প্রযুক্তিবিদ্যার সারিতে এক বিস্ময়কর সংযোজন কম্পিউটার। কম্পিউটার এমন একটি যন্ত্র, যা মানুষের কাজের ব্যাপক অংশ নিজেই করে নিচ্ছে। সারা পৃথিবীকে এনে দিয়েছে নিজের ঘরে। তাই মানুষ হয়ে পড়েছে কম্পিউটার-নির্ভর। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই।

কম্পিউটার কী? : কম্পিউটার বলতে এমন একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র বোঝায়, যা অগণিত উপাত্ত সংগ্রহ করে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে পারে। ‘কম্পিউটার’ শব্দটি ইংরেজি এবং এর অর্থ হলো গণকযন্ত্র। হিসাবের যন্ত্র বলে এটি যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ জাতীয় অঙ্ক কষতে পারে। কাজের গতি, বিশুদ্ধতা, নির্ভুলতা ও নির্ভরশীলতার দিক থেকে কম্পিউটারের ক্ষমতা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত।

কম্পিউটারের উদ্ভাবন ও ক্রমোন্নতি : কম্পিউটারের প্রাথমিক ধারণা আসে ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজ পরিকল্পিত একটি গণকযন্ত্র থেকে। তাঁর পরিকল্পনায় আধুনিক কম্পিউটারের গাণিতিক ইউনিট, স্মৃতিনিয়ন্ত্রক ইউনিট ও আউটপুট অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইলেকট্রনিকস শিল্পের দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কম্পিউটার হয়েছে অনেক সহজলভ্য। বর্তমানে কম্পিউটার একটি দেয়াল ঘড়ি বা ডায়েরির সমান আকারে নেমে এসেছে। বিজ্ঞানীর গবেষণাগার ছেড়ে এখন দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনে তার প্রতিষ্ঠা।

বাংলাদেশে কম্পিউটার : আশির দশকের গোড়ার দিকে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশে কম্পিউটারের বাণিজ্যিক বাজার হয়। সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের প্রচলন শুরু হয়। দেশের মানুষ তখন থেকে ব্যক্তিগতভাবে গৃহে প্রাতিষ্ঠানিক কাজে বা অফিস-আদালতে, কলকারখানায় কম্পিউটারের প্রচলন শুরু করে।

কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক : কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে দেশের বিপুলসংখ্যক লোক বেকার হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কেননা একটিমাত্র যন্ত্র কয়েকজন মানুষের কাজ একাই খুব অল্প সময়ের মধ্যে করে দিচ্ছে। ইন্টারনেট সুবিধা থাকার কারণে দেশের তরুণসমাজ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে এবং সেসব দেশের অপসংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। লেখাপড়া বন্ধ করে, স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে, টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে, বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা সাইবার ক্যাফেগুলোয় ভিড় জমাচ্ছে।

উপসংহার : আজ থেকে কয়েক দশক আগে বাংলাদেশে কম্পিউটার ব্যবহারের সূচনা। হালের বাংলাদেশ এ প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি। দেশের তরুণ প্রজন্মকে বাস্তবসম্মত উপায়ে কম্পিউটার শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশের সঠিক উন্নয়নের কাজে লাগানো হলেই আমরা পৃথিবীর অগ্রগামী দেশগুলোর সারিতে পৌঁছার যোগ্যতা অর্জন করতে পারব।

 

শীতের সকাল

ভূমিকা :   

কুয়াশায় ক্লান্তমুখ শীতের সকাল

পাতার ঝরোকা খুলে ডানা ঝাড়ে ক্লান্ত হরিয়লি

                (আহসান হাবীব)

ষড় ঋতুর খেলায় হেমন্তের পর আসে শীতের ধূসর বার্ধক্য। শুষ্কতা, রিক্ততা আর দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি সে। তবু শীতের সকালের একটা মাধুর্য আছে, কুয়াশা ঘেরা, শিশির ভেজা প্রভৃতির আছে স্নিগ্ধতা। সে শুধু বৈরাগী, উদাসী নয়। তার মধ্যেও রয়েছে আনন্দ, চাঞ্চল্যের বিভিন্ন উপাদান।

শীতের বৈশিষ্ট্য : বাংলাদেশে ষড় ঋতুর পঞ্চম ঋতু হলো শীত। শীত ঠিক গ্রীষ্মের বিপরীত। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস নিয়ে শীতকাল। শীতকালে আমাদের দেশে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে, তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে যায়। শীতকালে দিন ছোট আর রাত দীর্ঘ হয়।

শীতের সকালের রূপ বা প্রকৃতি : শীতের সকাল আসে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। প্রকৃতির পালাবদলের খেলায় শীতের সে রূপ রিক্ততার। তবে এ রিক্ততা প্রকৃতিকে এক ভিন্ন সাজে সজ্জিত করে। এ সময় গাছের পাতা ঝরে যায়। ঘন কুয়াশার কারণে সূর্যের মুখ দেখা যায় না। কর্মের আহ্বান সত্ত্বেও অজানা এক অলসতা মানুষকে বিছানায় আটকে রাখে। ধীরে ধীরে কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে সূর্য আলো ছড়াতে থাকে। হিম শীতল হাওয়া বইতে থাকে ধীরে ধীরে। গাছপালা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ে শিশির। শিশির ভেজা দূর্বাঘাস কিংবা টিনের চালে সূর্যের আলো পড়লে মনে হয় যেন মুক্তা ঝলমল করছে। সূর্যের উত্তাপ না ছড়ানো পর্যন্ত কেউ ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে চায় না। কিন্তু কাজকর্মের তাগিদে অবশেষে লেপ-কম্বল ছেড়ে উঠতে হয়। তবে সবার গায়ে তখন শীতের পোশাক জড়ানো থাকে।

গ্রামে শীতের সকাল : শীতের আসল সৌন্দর্য গ্রামেই। কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকে গ্রামের ভোর। এই ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতের মধ্যেই কৃষককে বের হতে হয় মাঠের উদ্দেশে। তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে ভোর থেকেই তারা ক্ষেতে বোনে বিভিন্ন রবিশস্য। কয়েক দিন পর যখন সেগুলোর কচি পাতা মাথা উঁচু করে, তখন চারদিকে বিরাজ করে এক অপূর্ব স্নিগ্ধতা, কোমলতা। শীতের সকালে রোদে বসে পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। এ স্মৃতি স্মরণ করে কবি সুফিয়া কামাল বলেছেন—‘পৌষ-পার্বণে পিঠা খেতে বসে/খুশিতে বিষম খেয়ে,/আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে/মায়ের বকুনি খেয়ে।’

খেজুর গাছে ঝুলতে থাকে রসের হাঁড়ি। গ্রামের মানুষেরা খড়কুটা জ্বালিয়ে আগুন পোহায়। গাছিরা খেজুরগাছ থেকে খেজুর রসের হাঁড়ি নামায়। বাড়িতে কৃষকের বউ সে রস জ্বাল দেয়। ছোট ছেলে-মেয়েরা মিষ্টি রোদে বসে গুড়-মুড়ি খায়। গ্রামের বধূরা শীতকালে নানা রকম পিঠা-পুলি তৈরি করে। গ্রামের শীতের সকালে সূর্য আসে সুখকর উষ্ণতা নিয়ে। কৃষক মাঠ থেকে ফসল আনে আর কৃষাণ বধূ ব্যস্ত হয়ে যায় সেই ফসল তোলার কাজে।

শহরে শীতের সকাল : শহরে তুলনামূলকভাবে শীতের প্রকোপ গ্রামের চেয়ে কম। শহরের মানুষ একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। তাই তাদের কাছে সকালটা যেন হুট করে চলে যায়। যারা চাকরি করে, তারা অফিসে যাওয়ার জন্য একটু আগে ঘুম থেকে উঠে চা-কফি খেয়ে, খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নাশতা করে ছোটে অফিসের উদ্দেশে। তবে দিনমজুররা কুয়াশা উপেক্ষা করেই ছোটে কাজের সন্ধানে। একদল লোক প্রাতভ্রমণে বের হয়। এ সময় রাস্তার পাশে মাটির চুলা জ্বালিয়ে ভাপা-চিতই পিঠা ও চা বিক্রি করার কাজে অনেকে ব্যস্ত থাকে।

শীতের সকালে দরিদ্র মানুষের অবস্থা : দরিদ্র লোকের জন্য শীত যেন অভিশাপ। গ্রামের মানুষের তবু মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, কিন্তু শহরের ছিন্নমূল মানুষ ফুটপাতে, রেলস্টেশনে, যেখানে একটু জায়গা পায়, সেখানেই ঘুমায়। শীতের কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই বলে তারা সূর্যের উষ্ণতার জন্য অপেক্ষা করে।

শীত সকালে লোকটা কাঁপে/ কাঁদে সবার পা ধরে।/একটা শুধু ছিল জামা,/ তা-ও ছিঁড়েছে ভাদরে।/হি-হি শীতে থাকে পড়ে/ ডাকে না কেউ আদরে।    (শামসুর রাহমান)

উপসংহার : শীতের সকালে যেমন আনন্দ আছে, তেমনি কষ্টও আছে। দরিদ্র মানুষের কাছে শীতের সকাল উৎসব-আনন্দের নয়, তাদের কাছে তা কষ্টের, যন্ত্রণার। তাদের এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হলে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

 

আমার প্রিয় শখ : বাগান করা

ভূমিকা : কর্মময় জীবনের অবসরে আনন্দ ও আত্মতৃপ্তি পাওয়ার জন্য প্রায় প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনো পছন্দের বা শখের কাজ করে। ব্যক্তিভেদে এই শখের কাজ নানা রকমের হয়। যেমন- কেউ শখ করে বই পড়ে, কেউ ছবি আঁকে, কেউ রান্না করতে পছন্দ করে আবার কেউবা বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিট অথবা মুদ্রা সংগ্রহ করতে ভালোবাসে। আর কেউ কেউ ভালোবাসে বাগান করতে। বাগান করা আমার প্রিয় শখ।

প্রিয় হওয়ার কারণ : বাগান করার শখটা শৈশব থেকেই আমার অস্থি মজ্জায় ঢুকে গেছে। আমার বাবা আমাদের বাড়িতে সারা বছরই নানা রকম ফলের গাছ, ওষধি গাছ লাগিয়ে আমাদের বাড়িটিকে বাগানবাড়ি করে তুলেছেন। গাছ লাগানোর সময় তিনি আমাদের ভাই-বোনদের সঙ্গে রাখতেন আর বলতেন যে গাছ লাগাবে, গাছের যত্ন করবে, বড় হলে সেটা তারই গাছ হবে। এভাবে উৎসাহ পেয়ে বাবার সঙ্গে বাসায় আমি একটা করে আম, পেয়ারা, লেবু ও জামরুলগাছ লাগিয়েছি। তারপর মনে হয়েছে এবার একটা ফুলের বাগান করব। ভাবনাটা মাথায় আসামাত্রই তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি।

শখের বর্ণনা : আমার পড়ার ঘরের সামনে একটুখানি খালি জায়গায় আমি ফুলের বাগান করেছি। আমি নিজেই মাটি কুপিয়ে জায়গাটা তৈরি করেছি। তারপর ফাঁক ফাঁক করে বিভিন্ন ডিজাইন করে ইট দিয়ে ঘেরাও করে দিয়েছি, যাতে কুকুর-ছাগল আর মুরগি ঢুকতে না পারে। আমার বাগানে বিভিন্ন রঙের গোলাপ, টগর, গাদা, বেলি, সূর্যমুখী ও ডালিয়া রয়েছে। জায়গা কম বলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বড় জাতের ফুলের গাছ লাগাতে পারিনি। তবে এই ফুলগুলোই যখন একসঙ্গে  ফোটে, তখন মনে হয় বাগানটি আলোয় আলোয় ভরে গেছে। আমি স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিনই আমার বাগানের পরিচর্যা করি। আমাদের বাসায় যাঁরাই বেড়াতে আসেন, সবাই আমার বাগানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।

শখের কাজের প্রয়োজনীয়তা : প্রত্যেক মানুষের জীবনেই অবসর যাপন ও আনন্দ প্রয়োজন। শখের কাজের মধ্য দিয়েই সবচেয়ে আনন্দ ও আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। কারণ শুধু প্রয়োজন মিটলেই মণ ভরে না। মন ভরাতে হলে শখের কাজ করতে হয়। শখের কাজেই জীবন অর্থবহ ও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। তাই জীবনে শখের কাজের গুরুত্ব অপরিসীম।

উপসংহার : আমার নিজের তৈরি বাগান দেখে মনে হয়, যতই সুন্দর বাড়ি থাকুক, বাগানবিহীন বাড়ি শ্রীহীন ও নিরাভরণ লাগে। আমার বাগানের ফুলগুলো যখন মৃদুমন্দ বাতাসে দুলে ওঠে, তখন আমার মন এক অনাবিল আনন্দ ও তৃপ্তিতে ভরে যায়। তখন কবির মতো আমারও বলতে ইচ্ছা করে—

শুধু দেখো আর খুশি হও মনে/সূর্যের সাথে হাসির কিরণে/কেমন আমরা হেসে উঠি আর/দুলে দুলে নাড়ি মাথা।/ঘাসফুল। (জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র)

সর্বশেষ খবর