১ আগস্ট, ২০১৮ ০৮:৫৭
হিসাব-নিকাশ রাজশাহী বরিশালেও

ছয় কারণে বুলবুলের ভরাডুবি

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

ছয় কারণে বুলবুলের ভরাডুবি

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গত সোমবার নগরীর বিনোদপুর ইসলামীয়া কলেজ ভোট কেন্দ্রে বৃষ্টিতে ভিজে ভোট কারচুপির প্রতিবাদ করেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনের ভোট শেষ হয়েছে। এই ভোট নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে নানা অভিযোগ করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সাংগঠনিকভাবে বিএনপিকে ঐক্যবব্ধ করতে না পারায় পরাজিত হয়েছেন বিএনপি প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এ ছাড়া জামায়াতকে পাশে না পাওয়া, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়ে ক্ষোভ ও নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপির পথসভায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় বেকায়দায় পড়েন বুলবুল। শেষ পর্যন্ত তিনি আর এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মূলত ছয় কারণে এবারের নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে বিএনপি প্রার্থীর। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, ২০১৬ সালে বুলবুল নগর বিএনপির সভাপতি হন। মিজানুর রহমান মিনুকে সরিয়ে তিনি সভাপতি হলে ক্ষোভ দেখায় দলের একটি অংশ। কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে সেই ক্ষোভ নিরসন হলেও দুই বছরে কোনো ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে পারেননি বুলবুল। মিজানুর রহমান মিনুর সময় গঠন করা ৩৭ সাংগঠনিক কমিটির নেতারাই ছিলেন এবারের নির্বাচনের দায়িত্বে। ক্ষোভ থেকে ওই নেতারা মেয়রের পরিবর্তে কাউন্সিলরের জন্য মাঠে কাজ করেছেন। এ ছাড়া মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তফশিল ঘোষণার পর বুলবুল ছুটে গিয়েছিলেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফার কাছে। সে সময় এ দুই নেতার মধ্যে কিছুটা তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। তবে বুলবুল দুঃখ প্রকাশ করলে প্রচারণায় মাঠে নামেন নাদিম। কিন্তু তা আন্তরিক ছিল না বলে জানিয়েছেন নাদিমের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা। কমিটি গঠন আর যোগাযোগ না রাখায় মিনু, নাদিম ও মিলন প্রচারে থাকলেও তা গত নির্বাচনের মতো ছিল না। তবে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফা জানান, বুলবুল মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর যোগাযোগ না রাখলেও তারা আন্তরিকতার সঙ্গেই কাজ করেছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের কিছু এলাকায় জামায়াতের শক্ত অবস্থান থাকলেও এবার নির্বাচনী প্রচারে ২০-দলীয় জোটের শরিক দলটিকে পাশে পায়নি বিএনপি। আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ‘হামলা ও বাধাকে’ এর কারণ দেখিয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের নেতারা। তবে একে বিএনপি জোটে বিভেদের ইঙ্গিত হিসেবে দেখেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। বিএনপির প্রার্থী বুলবুলের সঙ্গে জামায়াত না থাকায় প্রশ্ন ওঠার পর ২৬ জুলাই থেকে তারা ‘মাঠে নামবে’ বলে রাজশাহীতে জানিয়েছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। কিন্তু এর পরও জামায়াতকে ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে দেখা যায়নি। কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আশরাফুল আলম ইমনের এক ফেসবুক স্ট্যাটাসেও রাজশাহীতে দুই দলের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সেলের এই সদস্য সেখানে লেখেন, ‘২০১৩ সালে জামায়াত-শিবির বুলবুল ভাইয়ের নির্বাচনী মাঠে ছিল। অথচ এবার ২০১৮ সালে নেই কেন? এই ব্যর্থতা কার? রাজশাহী বিএনপির ঘাঁটি হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতের সঙ্গবিহীন বুলবুল ভাই বিজয়ী হওয়া তো দূরের কথা, ঠিকমতো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারবেন কি না তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’

মামলার জালে আটকা পড়ে দীর্ঘদিন নগর ভবনের বাইরে ছিলেন মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এই সময়ে দায়িত্বে থাকা ভারপ্রাপ্ত মেয়র হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়ে দেন। এ নিয়ে ক্ষোভ ছিল সাধারণ মানুষের। সাধারণ মানুষের সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে বুলবুল ঘোষণা করেছিলেন ‘এক দিনের জন্য’ মেয়রের চেয়ারে বসতে পারলে হোল্ডিং ট্যাক্স কমিয়ে দেবেন। কিন্তু সেই কাজ আর করেননি তিনি। নাগরিকদের সেই ক্ষোভও পড়েছে এবারের ভোটে এমনটাই মনে করেন নাগরিক আন্দোলনের নেতা জামাত খান। দায়িত্বের শেষ দিকে এসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন বুলবুল। কর্মচারী ইউনিয়ন প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবার প্রকাশ্যে ভোটের মাঠে কাজ করেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটনের জন্য। রাসিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি দুলাল শেখ জানান, মেয়র হিসেবে বুলবুল ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এ কারণে সব কর্মচারী তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। নগরীর ৩০ ভাগ ভোটার তরুণ। এই তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে দায়িত্ব পালন করার সময় কোনো উদ্যোগই নেননি বুলবুল। আগের মেয়রের গড়া ওয়াইফাই জোনটিও বন্ধ করে দেন তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর। যেখানে লিটন তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে তার ইশতেহারে নানা কর্মসূচির কথা বলেছেন, সেখানে বুলবুলের ইশতেহার ছিল তরুণবিমুখ। ভোটের মাঠে তরুণরা এ কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলে মনে করেন বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রচেষ্টার নির্বাহী প্রধান ফয়জুল্লাহ চৌধুরী। দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে মতভেদ, জামায়াতকে পাশে না পাওয়ায় বুলবুল যতটা বেকায়দায় পড়েছিলেন, এর চেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েন তার প্রচারণার পথসভায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায়। ওই ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টুকে আটক করে পুলিশ। মন্টুর একটি ফোনালাপ পুলিশ প্রকাশ করে। তাতে নাটোর ও রাজশাহীর দুই ‘বড়ভাই’ এ ঘটনায় জড়িত বলে উল্লেখ করেন মন্টু। ওই বড়ভাই হিসেবে আলোচিত হন মিজানুর রহমান মিনু ও রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। এ ঘটনার পর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু আর প্রচারণায় নামেননি। নির্বাচনে ভোটারদের সহানুভূতি পেতে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে ফাঁস হওয়ার পর তা বুলবুলের জন্য বুমেরাং হয়েছে। তবে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এসব ঘটনার একটির সঙ্গেও একমত পোষণ করেননি। তিনি বলেন, ‘কাল (৩০ জুলাই) কী হয়েছে আপনারা দেখেছেন। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ কীভাবে ভোটডাকাতি করেছে। মানুষ তো ভোটকেন্দ্রে যেতেই পারেনি। জনগণই একদিন এর বিচার করবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর