মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ফিরে আসুক যাত্রার সুদিন

ফিরে আসুক যাত্রার সুদিন

গ্রাম-বাংলায় যাত্রাপালার একটি দৃশ্য

প্রাচীনকাল থেকেই ‘যাত্রাপালা’ বাংলা সংস্কৃতিতে অবদান রেখেছে। বিনোদনের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই রঙ্গমঞ্চ। বাঙালি জাতির গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে মিশে রয়েছে ‘যাত্রাগান’। জাতির আদি সংস্কৃতি হিসেবে এসেছে যাত্রা। আর এ যাত্রা থেকেই এসেছে নাটক, থিয়েটার ও সিনেমা। কিন্তু এই আদি সংস্কৃতি যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। শীতকাল যাত্রাপালার ভরা মৌসুম সত্ত্বেও বিশাল আকারে যাত্রাপালার মঞ্চায়ন নেই। অশ্লীলতাসহ নানা অবক্ষয়ে বিধ্বস্তপ্রায় বাঙালির প্রাণের এই শিল্পটি। এ নিয়ে বিশেষ আয়োজন-

যাত্রাশিল্পের ঐতিহ্য

‘যাত্রা’ শব্দটির সঙ্গে বাঙালির দীর্ঘকালের আনন্দ-বেদনার সম্পর্ক রয়েছে। হাজার বছরের এই নাট্যঐতিহ্য যাত্রার সূচনা বাংলার শৈব ও সূর্যপূজার মাধ্যমে। যে পূজার প্রচলন করেছিলেন বাংলার ভ্রাম্যমাণ নৃত্যশিল্পীরা। ষোড়শ শতকে সূর্যের দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরুর মুহূর্ত থেকে অনুষ্ঠিত হতো সূর্যপূজা; সূর্যের গমন থেকে যাত্রার উৎপত্তি। এ যাত্রা শুরু হতো শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রার পর থেকে দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিন পর্যন্ত। এ সময় পালা রচনা এবং মহড়া অনুষ্ঠিত হতো। প্রাচীন নাট্যধারায় দুই ধরনের নাটকের সন্ধান পাওয়া যায়, যার একটি মঞ্চস্থ হতো উন্মুক্ত মঞ্চে অন্যটি প্রেক্ষাগৃহে। বিভিন্ন সময় এর শিল্পরীতি পরিবর্তিত হলেও যাত্রা বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে আজও রয়ে গেছে জনপদের মুক্ত মঞ্চে। যাত্রার আরেক নাম পালাগান। এ গান মানুষের লোকায়ত জীবনকে উজ্জীবিত করত। এর কাহিনী হিসেবে রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য ধর্মীয় পুরাণ ছিল সাধারণ জনগণের প্রধান আকর্ষণ। বিশ শতকের গোড়ার দিকে পালা পরিবেশনকালে সংযোজিত হয় ‘বিবেক’ চরিত্র। বিবেক চরিত্র মূলত ভালো বা মন্দের প্রতীক। উনিশ শতকে যাত্রাপালায় কবিগানের মতোই দোহারের কণ্ঠে গান এবং অভিনয়াংশের প্রাধান্য বাড়ে। যাত্রার মূূল অভিনয় শুরু হওয়ার আগে কিছু প্রাথমিক কৃত্যাদি সম্পন্ন হয়। বাদ্যযন্ত্রী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, বিবেক, প্রমটার, নৃত্যকীর সমন্বয়ে উপস্থাপিত হয় যাত্রার পরিবেশনা। তবে আধুনিকতার নামে অন্যের সংস্কৃতির হাওয়া লেগে যাত্রার চরিত্রধর্ম বদলে গেছে। আবার যাত্রা পেশাদারি শিল্প মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে নানারকম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। শিল্পীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা অধিকাংশ সময় নিশ্চিত থাকে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আনুকূলত্য নেই বললেই চলে। বর্তমানে নিবন্ধনকৃত ৮৮টি দল নিয়মিত যাত্রা পরিবেশন করে।

বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ, যাত্রা মালিক সমিতি ও যাত্রা পালাকার সমিতি তিনটি সংগঠন যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে নিরলস কাজ করছে।

যাত্রায় অশ্লীল নৃত্য

যাত্রাপালা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দুর্বৃত্তায়ন চলছে। যাত্রার অনুমতি পাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। যারা যাত্রার নামে অনৈতিকতার আশ্রয় নেয় তারাই প্রশাসনের নাকের ডগায় অশ্লীলতা, জুয়া, হাউজি চালিয়ে আসছে। মানে শর্ষের মধ্যেই ভূত। এতে অনেক আগে থেকেই পরিবার নিয়ে যাত্রা দেখার প্রবণতা কমে গেছে। সুস্থ যাত্রা অয়োজনে সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার, যা এখন নেই বললেই চলে। প্রশাসনকে বলব, প্রতি জেলায় যাত্রামঞ্চ নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হোক, সুস্থ যাত্রা যাতে মঞ্চায়ন হয় সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হোক, প্রকৃত দলগুলোকে হয়রানি ছাড়াই অনুমতি দেওয়া হোক, যাত্রার সঙ্গে জড়িত দুর্বৃত্তদের শাস্তি দেওয়া হোক এবং যাত্রাশিল্পে সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হোক- যাতে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ১৫ লাখ মানুষ সচ্ছলভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।

একাধিক মফস্বল শহরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রায় নৃত্যের নামে শুরু হয় চরম অশ্লীলতা। একই সঙ্গে জুয়া আর হাউজি তো রয়েছেই। এগুলো তত্ত্বাবধান করে স্থানীয় মাস্তানরা। আয়োজকরা বলতে গেলে তাদের কাছে জিম্মি থাকে। অনেক আয়োজকও আবার এই অনৈতিকতার সঙ্গে জড়িত থাকেন। পুলিশরা মাঝে মধ্যে আশপাশে থাকলেও তারা থাকে নির্বিকার। অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনকে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে চলে যাত্রার নামে নানা ধরনের অনৈতিকতা। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পায় না।

যাত্রাশিল্পের অবক্ষয়রোধে সরকারের সহযোগিতায় যাত্রাশিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০১২ বাস্তবায়ন ও যাত্রাদল নিবন্ধনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি উদ্যোগ নেয়। ২০১৩ সালে একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভাগের তত্ত্বাবধানে বিচারকদের উপস্থিতিতে যাত্রাদলকে নিবন্ধিত করা শুরু হয়।

যাত্রা সংশ্লিষ্টদের কথায়- যাত্রার বর্তমান চালচিত্র খুবই উদ্বেগজনক। বেশির ভাগ যাত্রাদলেই অভিনয় নেই, অনুশীলন নেই, সাহিত্য নেই, আছে শুধু একদল নারীর নাচ। সচেতন দর্শকরা বলছেন, যাত্রার সঙ্গে নাচ থাকবেই। কিন্তু সেটা নোংরা হবে কেন? আমরা যদি প্রকৃতই ঐতিহ্যবাহী যাত্রাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই, তাহলে সরকারি ও প্রশাসনিক পর্যায়ে জরুরি ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ডিসি অফিস থেকে যখন যাত্রানুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হবে, তখন আয়োজক ও দল মালিকদের কাছ থেকে এ মর্মে লিখিত অঙ্গীকার থাকবে- তারা অশ্লীলতা প্রদর্শন করবে না। যাত্রানুষ্ঠানের ভালো-মন্দ দেখার জন্য থানার পুলিশকে কঠোর নির্দেশ দিতে হবে। যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের দীর্ঘদিনের দাবি অশ্লীলতা প্রতিরোধে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করা।

প্রখ্যাত যাত্রা সংগঠক মিলন কান্তি দে বলেন, বর্তমান সরকার যাত্রাদলকে নিবন্ধন দিচ্ছে। একটি নীতিমালাও তৈরি হয়েছে। কিন্তু নীতিমালা অনুযায়ী সহজ, স্বচ্ছ ও সুন্দরভাবে হয়রানি না করে যাত্রা আয়োজনের অনুমতি দেওয়ার কথা থাকলেও আয়োজকদের অজানা কারণে দিনের পর দিন অনুমতির জন্য ঘুরতে হয়। মানে চরম হয়রানির শিকার হতে হয়। অনেক জেলায় ডিসি অনুমতি দেন না। তা হলে নিবন্ধন দিয়ে লাভ কি হলো? একেকটি দল করতে ২০ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়। অনুমতি না পেলে এসব দল শীত মৌসুমে তাদের পুঁজি ফেরত পাবে না। তাদের মানবেতর জীবনযাপনের মুখে পড়তে হবে। তাই সরকার, শিল্পকলা একাডেমি ও ডিসিদের এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর