বুধবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

অদক্ষ নির্মাতায় চলচ্চিত্রে খরা

আলাউদ্দীন মাজিদ

অদক্ষ নির্মাতায় চলচ্চিত্রে খরা

কেন সফল হচ্ছে না চলচ্চিত্র এবং প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না নতুন শিল্পীরা। এর কারণ হিসেবে দক্ষ নির্মাতার অভাবকেই দায়ী করলেন চলচ্চিত্রবোদ্ধারা।

‘চলচ্চিত্র নির্মাণে দক্ষ নির্মাতা নেই। নতুনদের যথাযথভাবে উপস্থাপন এবং তাদের কাছ থেকে অভিনয় আদায় করার মতো নির্মাতা কোথায়? শবনম, শাবানা থেকে শুরু করে শাবনাজ, শাবনূর এবং নাদিম, নাঈমের মতো ছেলেমেয়েকে চলচ্চিত্রে এনে সুপারস্টারে পরিণত করেন তারকা সৃষ্টির কারিগর-খ্যাত চলচ্চিত্রকার এহতেশাম। পাশাপাশি খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত চট্টগ্রামের সাধারণ মেয়ে মীনা পালকে তার ‘সুতরাং’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ‘অভিনেত্রী কবরী’ সৃষ্টি করেছেন। বর্তমান সময়ের নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান একে একে মৌসুমী, সালমান শাহ, শাকিল খান, শাকিব খানের মতো নতুনদের নিয়ে কাজ করে রাতারাতি তারকা হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠা করেন। তখন তো বুকিং এজেন্ট, প্রেক্ষাগৃহ মালিক বা প্রযোজকরা এ নিয়ে আপত্তি করেননি। অথবা দর্শকও প্রেক্ষাগৃহবিমুখ হয়নি।’ চরম ক্ষোভ নিয়ে এ মন্তব্য করেন চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম।

চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন বলেন, একদিকে মানসম্মত গল্প নেই, অন্যদিকে দক্ষ নির্মাতার অভাব। ফলে চলচ্চিত্র এবং নতুন শিল্পী দুটিই ব্যর্থ হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্রে চলছে নকলের মহা-উৎসব। নিজেদের গল্প নিয়ে এখনকার নির্মাতারা ছবি নির্মাণ করতে চায় না। এখনকার অনেক নির্মাতার মধ্যে শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই বলেই তারা এমন অবান্তর কাজ করছে। ফলে চলচ্চিত্র ও নতুন শিল্পী আর আলোর মুখ দেখছে না।

চলচ্চিত্রকার সুচন্দার কথায়, বর্তমানে চলচ্চিত্র ও তারকা নিয়ে একটি চক্র নোংরা রাজনীতি করছে। ফলে শিল্পটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দক্ষ নির্মাতার অভাবেই তারকা হতে পারছে না নতুনরা। প্রেক্ষাগৃহ মালিক ও সিনিয়র নির্মাতার অনাগ্রহের কারণে প্রযোজকরা চাইলেও নতুনদের নিয়ে কাজ করতে পারছেন না। এ দেশে নতুন শিল্পী নেই— এ কথা একেবারেই মিথ্যা। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে অসংখ্য শিল্পী উত্তীর্ণ হয়ে আসছে। তাদের যদি অভিনয় দক্ষতা না থাকত, তবে উত্তীর্ণ হলো কীভাবে। এদের মধ্যে কয়েকজন হলেন— নিলয়, মিমো, শম্পা, সাগর, আরজু, আঁচল, তমা মির্জাসহ আরও অনেকে। তাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু দক্ষ নির্মাতার কারিশমার অভাবে এসব শিল্পীর কাজ অতটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। দুঃখজনকভাবে ব্যর্থতার দায়ভার নির্মাতার পরিবর্তে নতুন শিল্পীকেই বহন করতে হচ্ছে। নতুনদের তারকায় পরিণত করতে সিনিয়র দক্ষ নির্মাতাদের এখনই এগিয়ে আসা উচিত।

চলচ্চিত্র নির্মাতা নারগিস আক্তার বলেন, বর্তমানে চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা বেড়েছে সত্যি, কিন্তু মান বাড়েনি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, এখন যারা নির্মাণে আসছে তাদের বেশির ভাগই প্রকৃত চলচ্চিত্রকার নয়, নাটক নির্মাতা। তারা স্বল্প বাজেটে চলচ্চিত্রের নামে নাটক তৈরি করে দর্শকের মধ্যে বিরক্তির উৎপাদন ঘটাচ্ছে। চলচ্চিত্র ও নাটক কিংবা বড় ও ছোটপর্দা যদি একই হতো তাহলে প্রেক্ষাগৃহের কোনো দরকার হতো না। চলচ্চিত্রের উপাদান ভিন্ন। নির্মাণে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সচেতন না হলে সত্যিকারের চলচ্চিত্রের অভাব থেকেই যাবে এবং মন্দা অবস্থা কাটানো যাবে না। দেশে দ্রুত কমছে সিনেমা হলের সংখ্যা। নানা কারণে দেশীয় চলচ্চিত্রের দর্শক না থাকায় একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো। বর্তমানে দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চলচ্চিত্রের পরিবর্তে নাটক দেখতে হচ্ছে। এতে তারা হতাশা নিয়ে প্রেক্ষাগৃহবিমুখ হচ্ছে। ফলে চলচ্চিত্র ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। তাই চলচ্চিত্র নির্মাতা দিয়েই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। এক কথায় চলচ্চিত্রের ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় প্রকৃত চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রয়োজন।

ব্যাংকার ও কলামিস্ট রেজাউল করিম খোকনের কথায়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা করেছেন একশ্রেণির পরিচালক ও প্রযোজক। তারা পুরস্কারের টার্গেটে তৈরি করছেন তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল সিনেমা। যা কোনোভাবেই মান উত্তীর্ণ চলচ্চিত্র হিসেবে দাঁড়াতে পারছেন না। বাণিজ্যিকভাবেও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে এসব অখাদ্য চলচ্চিত্র। এ ধরনের চলচ্চিত্র না হচ্ছে নাটক, না টেলিফিল্ম। দর্শক পকেটের টাকা খরচ করে এসব ছবি দেখতে যাবেন কেন? আমাদের চলচ্চিত্রের আজকের বিপর্যয়ের জন্য কেউ কেউ স্যাটেলাইট টিভির প্রসারকে দায়ী করেন। টেলিভিশনে দেশি-বিদেশি চ্যানেলে হিন্দি, ইংরেজি সিনেমা, সিরিয়াল দেখার সুযোগ পেয়ে গাঁটের টাকা খরচ করে কেন প্রেক্ষাগৃহে যাবেন তেমন যুক্তি দেখান তারা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এবং পৃথিবীর সব দেশেই তো অগণিত টিভি চ্যানেল দেখার সুযোগ রয়েছে। দর্শক সেসব টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান, সিরিয়াল, সিনেমা দেখেও প্রেক্ষাগৃহে ভিড় করছেন নতুন নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি দেখার জন্য। ভারতে বর্তমানে একেকটি ব্লকবাস্টার হিন্দি সিনেমা ২০০-৩০০ কোটি রুপি ব্যবসা করছে। কলকাতার বাংলা সিনেমার মান আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। দর্শক আকৃষ্ট করার মতো অনেক কিছুই থাকছে কলকাতার সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমাগুলোয়। অপরিপক্ব মেধাহীন চিত্রনির্মাতাদের কবল থেকে আমাদের বাংলা সিনেমাকে রক্ষা করতে হবে। দর্শক মনে গভীরভাবে রেখাপাত করতে পারে কেবলমাত্র তেমন কাহিনী নিয়ে অভিজ্ঞ দক্ষ মেধাবী চিত্রনির্মাতারা যদি ভালো বাজেটে সুন্দর পরিকল্পনা করে ছবি তৈরি করেন তাহলে সে ছবি দেখতে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ভিড় করবেই। যেসব মেধাবী অভিজ্ঞ চলচ্চিত্র নির্মাতা অভিমান করে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে অন্য ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন, তাদের একটু কষ্ট স্বীকার করে আবার চলচ্চিত্রের হাল ধরতে হবে, অর্থলগ্নি করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রাণ ফিরে পাবে, আর চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

সর্বশেষ খবর