সোমবার, ২২ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে ভাটা

♦ তরুণ নির্মাতারা টেলিভিশনে আগ্রহী ♦ বিজ্ঞাপনের লোভনীয় হাতছানি ♦ রাজনৈতিক-সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই

আলাউদ্দীন মাজিদ

ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে ভাটা

প্রথম ভিন্ন ধারায় নির্মিত ছবি ‘আগামী’ নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। এটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। ছবিটি সব শ্রেণির দর্শকের নজর কাড়ে। এরপর এই ধারার চলচ্চিত্রের সুদিন শুরু হয়। জুনায়েদ হালিম, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, আবু সাইয়্যিদ, তারেক শাহরিয়ার, সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকি, মানজারে হাসান মুরাদ, নূরুল আলম আতিক, জাহিদুর রহমান অঞ্জন, সৈয়দা নিগার বানুর মতো নির্মাতারা এগিয়ে আসেন নির্মাণে। তাদের হাতে ভিন্ন ধারার ছবি সমৃদ্ধ হয়। গড়ে উঠে ‘প্যারালাল সিনে মুভমেন্ট’ শিরোনামের একটি সংগঠন। নব্বই দশক পর্যন্ত ছিল ভিন্ন ধারার ছবির জয়জয়কার। এরপর এ ধরনের ছবি নির্মাণে ভাটা পড়ে। ২০০০ সালের শুরু থেকে এ জাতীয় ছবি নির্মাণ হলেও তা পরিমাণে কম ও মানে দুর্বল। কিন্তু কেন এই অবস্থা? এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্রকর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জুনায়েদ হালিম বলেন, ‘আমরা যারা আশি ও নব্বই দশকে এ জাতীয় সিনেমা নির্মাণের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলাম তারা সে সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনাকে প্রকাশের অবলম্বন হিসেবে চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছিলাম। আশির দশক ছিল সামরিক শাসনের সময়। এ শাসনের জাঁতাকলে নিস্পিষ্ট করা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছিল তখনকার স্বৈরশাসকরা। এর বিরুদ্ধে ছাত্র, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আমরাও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এই অপশাসন প্রতিরোধে অবতীর্ণ হই। নব্বই দশকের পর এ ধরনের শাসনের অবসান ঘটলে বিষয়টির প্রয়োজন ফুরায়। তখন তারুণ্যের স্বপ্ন ছিল কালেকটিভ উইশেস। আর এখন উন্মুক্ত বিশ্বায়নের যুগে সব হয়ে পড়েছে ইনডিভিজুয়াল ড্রিম। পাশাপাশি নব্বই দশকের পর বৈশ্বিক পরিবর্তনের কারণে আর্থিক ও জাগতিক লাভ-লোকসানের হিসাব কষতে গিয়ে ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়টি যেন থমকে গেছে। তবে আমি হতাশ নই। এখন পৃথিবীজুড়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি আর উগ্রবাদ যে হারে আস্ফাালন করছে একটা সময় এ বিষয়টি এড্রেস করতে নতুন প্রজন্ম তাদের মেধামননকে কাজে লাগাবে বলে আমার বিশ্বাস’। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল বলেন, ‘একাধিক কারণে এমনটি হচ্ছে। প্রথমত, এ ধারার চলচ্চিত্রকারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কারণ নতুন প্রজন্মের ছেলেরা টেলিভিশনের জন্য নাটক-টেলিফিল্ম নির্মাণে বেশি আগ্রহ বোধ করে। বিকল্প ধারায় কষ্ট করে ছবি নির্মাণ করা এবং তা জেলা-উপজেলায় ঘুরে ঘুরে দর্শনীর বিনিময়ে দেখানোর কষ্টকর কাজটা তারা তেমন করতে চান না। এখন তো তরুণদের সামনে নানা রকম সম্ভাবনা। রয়েছে বিজ্ঞাপন নির্মাণের লোভনীয় হাতছানি, রয়েছে করপোরেট পুঁজির স্বার্থে টেলিভিশনের জন্য নানা রকম প্রোগ্রাম বা টেলিভিশনকেন্দ্রিক ছবি তৈরি করা। বিদেশি ফোন কোম্পানিগুলো এ ব্যাপারে অনেক টাকা লগ্নি করে। এর ফলে আমরা অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ নির্মাতা করপোরেট পুঁজির কাছে হারাচ্ছি। যারা বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন শুরু করেছিলেন বা এখনো করছেন, তাদের যে রাজনৈতিক-সামাজিক আদর্শবোধ ও দায়বদ্ধতা ছিল, এখনকার তরুণদের ততটা নেই। এখন তো আদর্শবোধকেই মনে করা হয় ‘বোকামি’! তা ছাড়া যে কোনো আন্দোলনকে ধারণ ও চালিত করার জন্য সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজন। এদেশে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের সংগঠনটি ছিল বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম। ইদানীং ফোরামের যারা নেতা রয়েছেন বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের সঙ্গে তারা তেমন জড়িত নন। এর জন্য তারা এ ধারার সমস্যাগুলোও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা ও সেসব সমস্যা দূর করার কাজে তেমন অবদান রাখতে পারছেন না। ফলে বিকল্প ধারার সিনেমার সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।’ প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আবু সাইয়্যিদ বলেন, ‘আশি ও নব্বই দশকে ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ একটি কমিটমেন্টের মাধ্যমে এগোতো। পরবর্তীতে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে নির্মাণে যাওয়ার আগে নির্মাতারা ‘বাণিজ্যিক’ ও ‘শৈল্পিক’ বিষয়টি নিয়ে ভাবনায় পড়েন। তারা কোন দিকে এগোলে লাভবান হবেন সেটি আগে ভাবেন। এখনকার তরুণ নির্মাতাদের মধ্যে ত্যাগের মনোভাব কম। দ্রুত অর্থ ও সুনাম প্রাপ্তির প্রবণতা এখনকার ভিন্ন ধারার ছবি নির্মাতাদের গতিরোধ করছে। এক্ষেত্রে আমাদের চিন্তা ভাবনাকে সুসংহত করতে হবে। ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতাকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। এখন যে এ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ কমে গেছে তা কিন্ত নয়। এখন কোয়ালিটিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না বলেই এসব কাজ চোখে পড়ছে না।’ প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলামও দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, ‘আমরা যখন ভিন্ন ধারা চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করি তখন তার নির্মাণ আঙ্গিক, বিষয়বস্তু নির্বাচন ও প্রদর্শন ব্যবস্থায় দর্শকের রুচি ও দেখার সহজলভ্যতার বিষয়টি প্রাধান্য পেত। বর্তমান সময়ে এসব ব্যবস্থার অভাবে এ ধারার ছবি দর্শক আগ্রহ তৈরি করতে পারছে না। তা ছাড়া এখন যারা নির্মাণে আসছেন তারা সংগঠিত নয়। এতে সামগ্রিকভাবে যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা তা আর মিলছে না।’

সর্বশেষ খবর