শনিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

তিন বোনের আত্মজীবনী

আলাউদ্দীন মাজিদ

তিন বোনের আত্মজীবনী

ঢাকাই চলচ্চিত্রের তিন কন্যা— সুচন্দা, ববিতা আর চম্পা। তিনজনই সমৃদ্ধ কাজ দিয়ে পূর্ণ করেছেন আমাদের চলচ্চিত্র ভাণ্ডার। সুচন্দার বেহুলা, জীবন থেকে নেয়া। ববিতার অশনি সংকেত, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে আর চম্পার পদ্মা নদীর মাঝিসহ অনেক ছবি এখনো জীবনের ছায়া ফেলে দর্শকের চোখে-মুখে। দেশীয় চলচ্চিত্রের সমৃদ্ধ চিত্র বলতেই মনের ফ্রেমে বাঁধাই হয়ে যায় তিন কন্যার ছবি। শুধু দেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও কাজের ব্যাপ্তি দিয়ে সুনাম করেছেন তারা। ষাট থেকে দুহাজার সালের প্রথম পর্যন্ত চলচ্চিত্র আঙিনায় ছিল তিন কন্যার সরব পদচারণা। এক সময় দেশীয় চলচ্চিত্র নানাভাবে কৌলীন্য হারালে তিনজনই অনেকটা দূরে সরেন এই অঙ্গন থেকে। তাদের অনুপস্থিতিতেও দর্শক খুঁজে ফেরেন তাদের। মানে বড় পর্দার আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় তিন বোনকে কখনো মনের আড়াল করতে পারছেন না দর্শক। এদেশের চলচ্চিত্রে তাদের অবদানের শেষ নেই। দর্শক তাদের চলচ্চিত্র দেখে তিন বোনের অভিনয় কারিশমা সম্পর্কে অল্পবিস্তর জেনেছেন। তাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও ছিটেফোঁটা ধারণা হয়েছে। এই জানার পরিধি আরও বাড়াতে চান দর্শক। দর্শকের মনের আকুতি উপলব্ধি করতে পেরেছেন বেহুলা কন্যা সুচন্দা। মানে তিন কন্যার একজন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘তিন কন্যার জীবনী’ লিখবেন। শিগগিরই শুরু করতে চান রচনার কাজ। তার কথায় অনেক দিন ধরেই এমন ভাবনা মনে সঞ্চিত আছে। সময় আর সুযোগ হচ্ছিল না। এখন ভাবছি সময়ের পেছনে ছুটে শুধু শুধু সময় নষ্ট করলে চলবে না। সময়কে আঁকড়ে ধরতে হবে। কাজটা যেভাবে হোক শুরু করতেই হবে। বইতে শুধু আমাদের ফিল্মি জীবন নয়, ব্যক্তিগত জীবনের অনেক না জানা কথা লিপিবদ্ধ করব। মুক্তিযুদ্ধে আমার ও জহির রায়হানের ভূমিকা। জহিরের নিরুদ্দেশ হওয়া। তিন বোনের নানা খুনসুটি। আমাদের জীবনে বাবা-মায়ের অবদানসহ আরও অনেক বিষয় আত্মজীবনীতে স্থান পাবে। ফিল্মি জীবনের মজার অনেক ঘটনাও তুলে ধরব এতে।

একটি মজার কথা এভাবেই বললেন কিংবদন্তি সুচন্দা। আমার প্রথম ছবি ‘কাগজের নৌকা’। নির্মাতা সুভাষ দত্ত। তখন চলচ্চিত্রের অনেক ভাষা আমার না বোঝার কথা। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালাম। সুভাষ দত্ত চিৎকার করে বলছেন, না হয়নি ওর চুল আরেকটু কাটো, না... না আরও আরও কাটো। ক্যামেরা অন। আমি তো কিছু বলতে পারছি না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। হায়রে আমার শখের চুলগুলো ছবিতে কাজ করতে এসে কেটে ফেলতে হচ্ছে। চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। পারছি না। শর্ট শেষ হলে বললাম দাদা আমার চুল কেটে ফেললেন। এখন কি হবে। সুভাষ দত্ত কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হো... হো করে হেসে উঠলেন। বললেন আরে বোকা এই কাটা সেই কাটা নয়। আমি চুলের উপর পড়া আলো কাটতে বলেছি। চুল নয়। দাদার কথা শুনে একদিকে স্বস্তি আরেকদিকে লজ্জা পেলাম। আসলে সবারই মনে হয় প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা এমনই হয়। এ ধরনের অনেক মজার ঘটনার কথাই থাকবে বইতে।

ববিতা বলেন, চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা মনকে ভীষণ পীড়া দেয়। এখনকার চলচ্চিত্র ব্যাকরণশূন্য। গল্প, নির্দেশনা, গান অভিনয় কোনোটিই যথাযথ নয়। নায়িকারা যেসব পোশাক-আশাক পরে তা শালীনতার সীমা মানে বলে মনে হয় না।  চলচ্চিত্র হচ্ছে পরিবার নিয়ে বিনোদিত হওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম। এই চলচ্চিত্রই যদি পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে দেখার মতো না হয় তাহলে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব আর কোথায় থাকছে। শুধু বড় পর্দা নয়, ছোট পর্দারও একই অবস্থা। নিজের অভিনয় জীবনের একটি ঘটনার কথা বলি- বরেণ্য নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে কাজ করছি। একটি দৃশ্যের প্রয়োজনে সত্যদা বললেন ‘তোমাকে ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরতে হবে।’ আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। দাদাকে বললাম, ‘আমি যদি আপনার ছবিতে ব্লাউজ না পরি তাহলে আমার দেশের নির্মাতারাও এমন দৃশ্যে অভিনয় করাতে চাইবেন। তখন আমি মহাবিপদে পড়ব। অন্য কোনোভাবে কিছু করা যায় না। সত্যজিৎ দা আমি কি বলতে চাইছি তা বুঝতে পারলেন। শাড়ির নিচে ফ্রক পরিয়ে সেই দৃশ্যে তিনি আমাকে অভিনয় করালেন। তার মতো এত বড়মাপের নির্মাতা আমার কথা না রাখলেও পারতেন। তিনি তা করলেন না। মনে হলো এ জন্যই তিনি বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব।

চম্পা বলেন, আমাদের সময় আমরা মানসম্মান বজায় রেখে কাজ করেছি বলে আজও দর্শক আমাদের তাদের মনের আড়াল হতে দেননি। আমরা শুধু কাজ বুঝতাম। চিন্তা করতাম কীভাবে সুস্থ বিনোদন দিয়ে দর্শকের মন রাঙানো যায়। গান, গল্প, চরিত্র, পোশাক-আশাক কোনো কিছুর সঙ্গেই কখনো আপস করিনি। আর এর প্রতিফল এখনো পাচ্ছি। দর্শক আমাদের যুগ যুগ ধরে মনে রেখেছে। এখনো ছোট পর্দায় আমাদের ছবি দেখানো হলে তারা তা আগ্রহ নিয়ে দেখে। খুশি হয়। নিজের কাছেও ভালো লাগে। মনে হয় সত্যিই চলচ্চিত্রের জন্য ভালো কিছু করতে পেরেছি। এ জন্য হয়তো পৃথিবী থেকে বিদায়ের পরেও মানুষ অনন্তকাল আমাদের মনে রাখবেন। এক জীবনে এটিই হলো সবচেয়ে বড় পাওয়া।

বড় বোন মানে সুচন্দা বুজি উদ্যোগ নিয়েছেন আমাদের জীবনকে ঘিরে আত্মজীবনী লিখবেন। বুজির এই চিন্তা আমাদের কর্মজীবনকে পূর্ণতা দেবে। দর্শক আমাদের ভালো কাজের প্রেরণা ও উৎসাহ সম্পর্কে জানতে পারবেন। আমরা তিনজনই খুব খুশি। খুবই এক্সাইটেড। কখন বইটি চোখের দেখা দেখতে পাব। কখন পাঠকের হাতে উঠবে তিন কন্যার জীবনচিত্র। হয়তো আর বেশি দিন নয়। সবার মতো আমরাও প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছি...।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর