বুধবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

এই বিটিভি সেই বিটিভি

এই বিটিভি সেই বিটিভি

১৯৬৪ সালে গোড়াপত্তন থেকেই মানসম্মত অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে দর্শকপ্রিয়তা পায় বাংলাদেশ টেলিভিশন। এই জাতীয় টিভি চ্যানেলটি আশির দশক পর্যন্ত জনপ্রিয়তা ধরে রাখে। নব্বই দশক থেকে চ্যানেলটির দর্শকপ্রিয়তায় অনেকটা ভাটা পড়ে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও দেশের একমাত্র টেরিস্ট্ররিয়াল চ্যানেল হওয়া সত্ত্বেও দর্শকের পছন্দের তালিকা থেকে নাম ছিটকে পড়েছে বিটিভির। অথচ একসময় বিটিভির এ সপ্তাহের নাটক, ধারাবাহিক নাটক এমনকি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জন্যও দর্শক ঘড়ি ধরে অপেক্ষা করত। স্যাটেলাইট কালচারে দর্শকের রুচি পাল্টেছে। ক্ষেত্র বিশেষে পাল্টেছে বিটিভিও। কিন্তু সেই পরিবর্তন কোনোমতেই গ্রহণ করছে না দর্শক। বিটিভির সেই জৌলুস হারানোর কারণ জানিয়েছেন বেশ কজন টিভি ব্যক্তিত্ব। তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন—আলাউদ্দীন মাজিদ

 

‘তখন যারা বিটিভিতে আসতেন তারা শুধু চাকরি নয়, দায়িত্ব নিয়ে ক্রিয়েটিভ কাজ করতেন’

— নওয়াজীশ আলী খান

উপদেষ্টা-অনুষ্ঠান, এটিএন বাংলা

কালের বিবর্তনে সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। বিটিভিরও হয়েছে। একসময় এটি একমাত্র চ্যানেল ছিল এদেশে। তাই আমরা যা দেখাতাম দর্শক তাই দেখত। কারণ তাদের অন্য কোনো অপশন ছিল না। এখন সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিও বদলেছে। পছন্দের পরিবর্তন হয়েছে। তুলনা করার মতো অবস্থাও তৈরি হয়েছে। তখন যারা বিটিভিতে আসতেন তারা শুধু চাকরি নয়, দায়িত্ব নিয়ে ক্রিয়েটিভ কাজ করতেন। এক কথায় কাজ পাগল ছিলেন সবাই। মানুষকে সর্বোচ্চ বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা থাকত। এই দায়িত্বশীলতা এখন কতটা আছে তা আমার জানা নেই। আমরা যারা তখন বিটিভিতে যোগ দেই রীতিমতো তিন মাসের সিটিআই ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আসতে হয়েছে। প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছে। তিনবার ইন্টারভিউ দিতে হতো। এখন এই অবস্থা কোথায়। এখন তো বিসিএস করে যোগদান করা যায়। এখন অনেক প্রাইভেট টিভি চ্যানেল হয়েছে। জানা শোনা থাকলে যোগ দেওয়া যায়। আর অন্য চ্যানেল থেকে বেশি বেতন পেলে আসা যায়। এখনকার সবার মধ্যে চাকরি করাটাই মুখ্য। আরেকটি বিষয় হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজ-কর্ম সব সময়ই ধীরগতি সম্পন্ন হয়। সবমিলিয়ে বলব সময়ের পরিবর্তনে বদলেছে বিটিভিও।

 

‘টিভি চ্যানেলে কাজ করতে গেলে ক্রিয়েটিভিটি ও কমিটমেন্টই প্রধান। এখন এসবের বড়ই অভাব।’

—মোস্তফা কামাল সৈয়দ

অনুষ্ঠান প্রধান, এনটিভি

বিটিভি বদলে যাওয়ার প্রধান কারণ একটিই। আর তা হলো—সেই সময় যারা সেখানে ছিলেন এখন নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় রিপলেসমেন্ট যেভাবে হওয়া দরকার ছিল সেভাবে হয়নি। যারা এখন আছেন তাদের অভিজ্ঞতা আর কমিটমেন্ট কতটা আছে তাও দেখার বিষয়। আমরা বিটিভিতে যোগদানকে চাকরি হিসেবে নেইনি। দায়িত্ব পালনই ছিল আমাদের কাছে মুখ্য। আহ্বান সত্ত্বেও আমরা ক্যাডারে যোগ দেইনি। গেলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদ পেতাম। আমরা আসলে কমিটমেন্ট নিয়েই কাজ করতে চেয়েছি। ট্রেনিং নিয়ে যোগদান করেছি। এখন এসব নেই। তাছাড়া সরকারি মাধ্যম হিসেবে বিটিভির অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। আগে একমাত্র চ্যানেল হওয়ায় এতে বড় মাপের সব শিল্পী সাহিত্যিক একাধারে যুক্ত হতেন। একসময় ইউনিয়নের সমস্যা যুক্ত হয়। তাই নিচ থেকে প্রমোশন হওয়া শুরু করল। এতে কারও শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ক্রিয়েটিভিটি যথাযথভাবে যাচাই করা যায়নি। মানুষ হিসেবে কেমন তাও নির্বাচন সম্ভব হয়নি। টিভি চ্যানেলে কাজ করতে গেলে ক্রিয়েটিভিটি ও কমিটমেন্টই প্রধান। এখন এসবের বড়ই অভাব। সবাই শুধু অর্থের পেছনে ছুটছে। তাই পরিচালনা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আমরা যারা বিটিভির প্রথম প্রজন্মে ছিলাম তাদের কেউ এখন সেখানে নেই। এখন হয়তো টেকনিক্যাল দিকের উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু ক্রিয়েটিভিটি ও কমিটমেন্টের উন্নয়ন কতটা হয়েছে তাতে সন্দেহ রয়েছে। এখন শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও দক্ষতা নেই। ট্রেনিং নেই। আমাদের প্রথম প্রজন্মের রিপ্লেসমেন্ট হয়নি। বিটিভির জন্ম না হলে একুশে টিভি বা অন্য কোনো চ্যানেলের জন্ম হতো না। বর্তমানে বিটিভির মানোন্নয়ন করতে হলে ঘাটতি অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তা ভিতরে বাইরে যেখানেই হোক। এখন তো উন্নয়ন করার জন্য সব ধরনের প্রভিশন আছে। দরকার শুধু সদিচ্ছার।

 

‘আমাদের সময় সবার কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। আমলা দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ হয় না।’

—মোস্তাফিজুর রহমান

প্রধান উপদেষ্টা, জিটিভি

আসলে সময়ের পরিপ্র্রেক্ষিতে সব কিছুই বদলায়। সব কিছু তো আর আগের মতো পাওয়া যাবে না তাই ভালো মন্দও সেভাবে বিচার করা যাবে না। আমার মতে সব কালচারাল প্রতিষ্ঠানে কালচারাল মাইন্ডের লোকজন থাকা দরকার। আমাদের সময় সবার কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল। আমলা দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ হয় না। এখন যারা এখানে আসছেন তারা বিসিএস করে আসছেন। তারা চাকরি করার মানসিকতা নিয়েই আসছেন। সংস্কৃতির চিন্তা বা আগ্রহ তাদের মধ্যে থাকছে না। এটিই ডিফিকাল্ট বিষয়। এসব নেতিবাচক দিকের উত্তরণ ঘটাতে পারলেই বিটিভির ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে।

 

 

‘বিটিভির সেই সময় ফিরিয়ে আনতে দরকার সত্যিকারের মেধাবী লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া’

— মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

চলচ্চিত্র নির্মাতা

বিটিভির বদলে যাওয়ার প্রথম কারণ হচ্ছে সেই সময়টা এখন আর এই সময়ে নেই। সময়ের সঙ্গে বিটিভি নিজেকে বদলাতে পারেনি। কেন পারেনি তার প্রধান কারণ হচ্ছে এর জন্য যেসব মানুষ প্রেজেনটেশন আর কনটেইন নিয়ে ভাববে তারা নেই। তাই মেধাবী নির্মাতা ও কলাকুশলী না থাকায় সেই সময়টাকে আর ধরে রাখা যায়নি। বিটিভির সেই সময় ফিরিয়ে আনতে দরকার সত্যিকারের মেধাবী লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া। যারা আসলেই প্রেজেনটেশন ও কনটেইন ফিরিয়ে আনতে পারবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর