শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

থিয়েটারে পারিবারিক উত্তরাধিকার

থিয়েটারে পারিবারিক উত্তরাধিকার

স্বাধীনতা পরবর্তীতে নব-নাট্যান্দোলনের পথ ধরে আমাদের মঞ্চ নাটক প্রবাহিত হয়েছিল নতুন সম্ভাবনায়। সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিপ্লবী ধারার মঞ্চনাটকের পাশাপাশি নাট্যাঙ্গন সামাজিক ও ঘটনাভিত্তিক, বাস্তবধর্মী, রোমান্টিক এমনকি কমেডি ধাঁচের নাট্যচর্চায় মনোনিবেশ করে। গত কয়েক বছর ধরে দেশব্যাপী নাটকের যে জাগরণ তৈরি হয়েছে তা আমাদের সংস্কৃতিতে মঞ্চনাটকে আরও বেশি শক্তিমান করেছে। মঞ্চনাটক এখন  নিয়মিত হচ্ছে। তবে এদেশের মঞ্চ  নাটককে বেগবান করছে ঐতিহ্যবাহী  কিছু পরিবার ও তাদের উত্তরসূরি। তাদের দেখানো পথ ধরেই বর্তমান থিয়েটার এগিয়ে যাচ্ছে সফলভাবে। সেই নিমিত্তেই থিয়েটার প্রাণ  কিছু পরিবারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আয়োজন সাজিয়েছেন- পান্থ আফজাল

 

এক নাগরিকের চার বাসিন্দা

শুধু ব্যক্তি বা গ্রুপ থিয়েটারে নয়, তারা মিশে আসেন সপরিবারে। এই পরিবারের চারজনই সংস্কৃতি অঙ্গনকে করেছে সমৃদ্ধ। পরিবারের চারজনই মিডিয়া তারকা এবং মঞ্চে আমাদের প্রিয় মুখ। আলী যাকের-সারা যাকের এবং তাদের সন্তান ইরেশ যাকের-শ্রিয়া যাকের।  ১৯৭২ সালে আলী যাকের আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন। সেই সময় আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন তিনি। ১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসমপ্রদায়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের বাকি ইতিহাস নাটকটিতে যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা। এ পর্যন্ত ১৫টি নাটকে ১৫০০ বারের বেশি অভিনয় করেছেন তিনি। থিয়েটার জগতে এই পরিবারের সরব উপস্থিটি সত্যিই অনবদ্য।

 

থিয়েটার প্রাণ তিনজন

বাংলাদেশের নব নাট্যচর্চায় রামেন্দু মজুমদার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। বাংলাদেশের নাটককে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি করাতে তিনি পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। বাংলাদেশের নাট্যজগতে রামেন্দু মজুমদারের পদচারণা পাঁচ দশক জুড়ে। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে মঞ্চ ও টেলিভিশনে বহু স্মরণীয় প্রযোজনায় অভিনয় করেছেন। অন্যদিকে ফেরদৌসী মজুমদার প্রতাপশালী বাংলাদেশি মঞ্চ ও টিভি অভিনেত্রী। স্বাধীনতা উত্তরকালে টিভি ও মঞ্চে সমান সফলতার সঙ্গে অভিনয় করে আসছেন। ধারাবাহিক নাটক সংশপ্তকে ‘হুরমতি’ চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বিপুল প্রশংসা লাভ করেন।  এই দুই মঞ্চ কিংবদন্তির  মেয়ে ত্রপা মজুমদার মঞ্চে অভিনয় ও নির্দেশনায় সবার প্রশংসা কুড়িয়েছেন। একসময় নাটকে অভিনয় করলেও এখন তিনি মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। এই পরিবারের তিন জনকেই এই সময়ে মঞ্চে দেখা যায় দুর্দান্ত পারফরমেন্সে।  

 

নাট্যাঙ্গন পরিবার

স্বনামধন্য নাট্যকার, অভিনেতা ও নির্দেশক ড. ইনামুল হক এবং লাকী ইনাম। দুই কন্যা হৃদি হক, প্রয়তি হক ও কন্যা জামাতা লিটু আনাম, সাজু খাদেম অভিনয় জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত। মঞ্চ ছাড়াও টেলিভিশন ও বেতার নাটকে লাকী ইনামের পদচারণা দীর্ঘকালের। ১৯৯৫ সালে লাকী ইনাম এবং ড. ইনামুল হক নাগরিক নাট্যাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে নাট্য রচনা, নির্দেশনা, অভিনয়ে এই দম্পতি নিজেদের নাট্যদলকে ক্রমাগত ঋদ্ধ করে চলেছেন। প্রকাশ করেছেন নাট্য, পত্রিকা এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন নাট্য প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়। তাদের নিজেদের সংসার ও নাটকের সংসার মিলেমিশে একাকার ।

 

তাদের বসবাস ঢাকা থিয়েটারে

ঢাকার থিয়েটার মঞ্চে দেদীপ্যমান এই পরিবার। বিশিষ্ট নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং  শিমুল ইউসুফ। অন্যদিকে তাদের মেয়ে এশা ইউসুফ মঞ্চে কাজ করছেন সফলভাবেই। নাসির উদ্দীন ইউসুফ ১৯৭২ সালে নাট্যকার সেলিম আল দীনকে নিয়ে নাট্যক্রম মঞ্চদলের সঙ্গে নাটক নির্মাণ শুরু করেন।  অন্যদিকে, মাত্র ৫ বছর বয়সে শিমূল ইউসুফ শিশুশিল্পী হিসেবে মঞ্চে অভিনয় ও সঙ্গীত জীবন শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন এবং এ পর্যন্ত তিনি ঢাকা থিয়েটারের ৩৪টি নাটকে অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক, কোরিওগ্রাফার এবং পোশাক পরিকল্পনা, সহযোগী নির্দেশক ও পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজ করেছেন।

ঢাকা থিয়েটারের নাটক ‘আউটসাইডার’ এর নির্দেশনা দিয়েছেন মেয়ে এশা ইউসুফ। মঞ্চে অভিনয় করলেও তিনি ‘গল্প নিযে গল্প নাটক’ নামের আরেকটি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন।

 

প্রাঙ্গণেমোরে দুইজন

অনন্ত হীরা একজন তুখোড় মঞ্চ ও টিভি অভিনেতা, নাট্য নির্দেশক, নির্মাতা। অন্যদিকে অনন্ত হীরার সহধর্মিণী নূনা আফরোজ একই ধারায় জননন্দিত। অনন্ত হীরা ও নূনা আফরোজ দুই জনে মিলে একসময় গড়ে তোলেন নাট্যদল ‘প্রাঙ্গণেমোর’। নূনা আফরোজ প্রাঙ্গণেমোর-এর পরিচালক। তাদের  মঞ্চনাটকের দল ‘প্রাঙ্গণেমোর’।  প্রাঙ্গণেমোর প্রযোজিত নাটকগুলো হচ্ছে— স্বদেশী, রক্ত করবী, লোক নায়ক, দ্রোহ প্রেম নারী, শ্যামাপ্রেম ও শেষের কবিতা। শেষের কবিতাই বাংলাদেশের প্রথম মঞ্চ নাটক। যে নাটকটি কলকাতার শান্তি নিকেতন মঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছে।

 

নাট্যকেন্দ্রে ব্যস্ত তারা

বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা এবং নাট্যনির্দেশক তারিক আনাম খান। মঞ্চ, টেলিভিশন আর চলচ্চিত্র সব খানেই তার সরব উপস্থিতি। ১৯৯০ সালের ১১ অক্টোবর তিনি নাটকের দল নাট্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে মিলে শেকসপিয়রের নাটক ম্যাকবেথে কাজ করতে গিয়ে নিমা রহমানের সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হয়। পরবর্তীতে তাকেই তিনি বিয়ে করেন। অভিনয়ের পাশাপাশি নাট্যকেন্দ্র থেকে প্রযোজিত একাধিক নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। ছেলে আরিক আনাম খানের ইচ্ছাতেই আবার মঞ্চে ফিরে এসেছিলেন নিমা রহমান।  তবে, বাপ-ছেলে বিভিন্ন প্রযোজনায় দাপিয়ে অভিনয় করে যাচ্ছেন নিয়মিত। 

 

পরিবারে তারার মেলা

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নান্দনিক অভিনয় নৈপুণ্যে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে আলো ছড়িয়েছেন গুণী অভিনেতা আবুল হায়াত।  সম্প্রতি আসাদুজ্জামান নূরের নির্দেশনায় নাগরিক নাত্য সম্প্রদায়ের ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ নাটকের মাধ্যমে আবার মঞ্চে নিয়মিত হলেন এই গুণী অভিনয়শিল্পী।

বিপাশা হায়াত ১৯৮৫ সাল থেকে মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। মঞ্চে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়- দলে অভিনেত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে অভিনয়ের পাশাপাশি এই দলে সেট ডিজাইনার হিসেবেও কাজ করেছেন।

 

মেয়ে নাট্যকার, মা নির্দেশক

১৯৭৯ সালে পদাতিক নাট্যসংসদের সোজন বাদিয়ার ঘাট নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেন রোকেয়া রফিক বেবী। নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন এস এম সোলায়মান।  ১৯৯২ সালে থিয়েটার  আর্ট ইউনিটে যোগ দেন এই গুণী অভিনেত্রী।

 দলের হয়ে প্রথম গোলাপজান নাটকটিতে অভিনয় করেন তিনি। কয়েকদিন আগেই ঢাকার সেগুনবাগিচার জাতীয় নাট্যশালায় মেয়ের লেখা নাটক মঞ্চে নির্দেশনা দিয়েছেন মঞ্চ ও টিভি অভিনেত্রী এবং নির্দেশক রোকেয়া রফিক বেবী। মেয়ে আনিকা মাহিন একার লেখা ‘মর্ষকাম’ নাটকটি মঞ্চে নিয়ে এসেছে দেশের অন্যতম নাট্য সংগঠন থিয়েটার আর্ট ইউনিট।

সর্বশেষ খবর