রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অশ্লীলতার প্রতিবাদ করায় লাঞ্ছিত হয়েছিলাম

অশ্লীলতার প্রতিবাদ করায় লাঞ্ছিত হয়েছিলাম

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা অভিনয় ছেড়েছেন দুই বছরেরও বেশি সময় আগে। কথা ছিল মানসম্মত ছবি নির্মাণ হলে আবার ফিরবেন। তা আর হচ্ছে না। এখনকার ছবি নিয়ে হতাশ তিনি। চলচ্চিত্র নিয়ে হতাশার কথা জানতে তার মুখোমুখি হলে এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে ববিতা। তার ইন্টারভিউ নিয়েছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

কেমন আছেন?

খুব ভালো আছি বলা যাবে না। প্রিয় চলচ্চিত্র অঙ্গনের আজ খুবই বাজে অবস্থা। এমনটি কখনো চাইনি। চলচ্চিত্র হচ্ছে দেশের প্রধান গণমাধ্যম। এক সময় আমাদের চলচ্চিত্রের ছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে আমাদের ছবি অংশ নিত। সম্মান বয়ে আনতো। আমাদের শিল্পীরা তাসখন্দসহ পৃথিবীর বড়মাপের সব চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করতেন। এদেশের ছবি আর শিল্পীদের বাইরের দেশে সম্মানের সঙ্গে দেখা হতো। এখন কী সেই অবস্থা আছে? চলচ্চিত্রের নামে কী হচ্ছে? নির্মাণ, অভিনয়, গান, গল্প, পোশাক-পরিচ্ছদ এককথায় সব ক্ষেত্রেই চলছে অপসংস্কৃতি আর অবক্ষয়। এ অবস্থায় মন ভালো রাখব কী করে। চলচ্চিত্র অঙ্গনের দিকে তাকালে বুকটা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে।

 

এই মন্দ অবস্থা কাটিয়ে ওঠা যায় কী করে?

কাটিয়ে ওঠার মতো কোনো পথ আর অবশিষ্ট নেই। চলচ্চিত্র নিয়ে আর কোনো আশা-ভরসা নেই। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। সিনিয়রসহ প্রায় সবাই সরে এসেছে। চলচ্চিত্র নিয়ে নতুন করে আর কিছু ভাবতে চাই না।

 

তাহলে আর অভিনয়ে ফেরা হচ্ছে না?

প্রশ্নই আসে না। এই অবক্ষয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাই না। মানসম্মত কাজ করে যে সুনাম অর্জন করেছি তা রক্ষা করা এখন দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে পৃথিবী থেকে একদিন বিদায় নিতে হবে। চলে যাওয়ার পর কাজের মাধ্যমেই বেঁচে থাকতে হয় মানুষকে। এতদিন ভালো যা অর্জন করেছি তা ধরে রাখতে চাই। আমি জানি চলচ্চিত্র শিল্প আজ যে পতিত অবস্থায় চলে গেছে তা পুনরুদ্ধার করা দুঃসাধ্য। উদ্যোগ নিয়েও খুব একটা পজিটিভ রেজাল্ট পাওয়া যাবে না। এমন অবস্থায় অভিনয়ে ফিরব কি করে। চলচ্চিত্রে আর ফেরার ইচ্ছা নেই।

 

অনেকের মতে সিনিয়ররা উদ্যোগ নিলে ভালো কিছু হতে পারে?

কীভাবে হবে? এখন চলচ্চিত্র জগৎ যাদের ওপর নির্ভরশীল তারা কি কিছু করতে পারছে? চলচ্চিত্রে অস্থিরতা শুরু হলেও অনেক সিনিয়র নির্মাতা ও শিল্পী এ জগৎ ছেড়ে যাননি। তারা চেষ্টা করেছেন শিল্পটিকে বাঁচাতে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় এতে কারও সহযোগিতা পাওয়া দূরে থাক অনেককে লাঞ্ছিত পর্যন্ত হতে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলাম। ২০০৫ সাল। আমি তখন সেন্সর বোর্ডের সদস্য। শরীফউদ্দিন খান দীপু নামে এক প্রযোজক-পরিচালকের ‘হীরা আমার নাম’ ছবিটিতে মারাত্মক সব অশ্লীল দৃশ্য থাকায় তা ছাড় দিইনি বলে ওই নির্মাতা আমার সঙ্গে চরম অসদাচরণ করে। আমাকে দেখে নেবে বলে কঠিন হুমকি দেয়। নানাভাবে আমাকে লাঞ্ছিত করেছিল। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, সে সময়কার চলচ্চিত্রকাররা এ ব্যাপারে আমার পক্ষ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি বা কোনো কঠোর অবস্থানে যাননি। তাহলে বুঝতেই পারছেন সিনিয়ররা যদি উদ্যোগও নেন তাহলে এতে কতটা লাভ বা ক্ষতি হতে পারে। এ কারণেই সিনিয়ররা মানসম্মান বাঁচাতে ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন।

 

তাহলে বলছেন চলচ্চিত্র শিল্প একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে?

আগেই বলেছি চলচ্চিত্র শিল্প সব দিক দিয়ে শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে কো-প্রোডাকশনের নামে যা চলছে তাকে কী মানসম্মত কাজ বলা যায়।  ছবিগুলোতে নায়িকাদের পোশাকের নামে যা ব্যবহার করা হচ্ছে তা কী শালীনতার পর্যায়ে পড়ে। পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে কী তা দেখা যায়। বুকের নিচে আর হাঁটুর উপরে কাপড় থাকলে বাবা-মা, ভাইবোন একসঙ্গে বসে সেই ছবি দেখবে কী করে। আমরা বাঙালি। আমাদের গর্ব করার মতো সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য আছে। আধুনিকতার নামে শরীর প্রদর্শন করে এই সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দেওয়া কী উচিত? শুধু বড় পর্দায় নয়, এই অবক্ষয় এখন ছোট পর্দাকেও জেঁকে ধরেছে। একজন উপস্থাপিকাও  উগ্র পোশাক পরে আধুনিকতার নামে বাঙালিয়ানাকে কুলষিত করছে। এ জন্য শিল্পী দায়ী নয়, নির্মাতাদের নির্দেশেই তারা এমনটা করছে। একটি উদাহরণ দিই। আমি যখন সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে কাজ করছি তখন সত্যজিৎ দা আমাকে বললেন ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরতে হবে। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম গল্পের প্রয়োজনে এমন পোশাক পরতে আমি রাজি। তবে পরে এটি আমার দেশে নিয়মে পরিণত হতে পারে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নির্মাতারা এভাবে শাড়ি পরতে বলতে পারেন। তখন আমার কী হবে। বিচক্ষণ সত্যজিৎ দা আমার কথার যৌক্তিকতা বুঝতে পেরে পরে ব্লাউজ ছাড়া শাড়ির বিষয়টি বাদ দেন। তাই বলব সদিচ্ছা থাকলে শিল্পকে রক্ষায় ভালো সব কিছু করাই সম্ভব। কিন্তু এ অবস্থা এখন কোথায়?

 

তাহলে চলচ্চিত্র রক্ষার আর কোনো পথ নেই?

একেবারেই যে নেই তা বলব না। মানুষ নিকষ কালো অন্ধকারেও আলোর দিশা খোঁজে। আমিও তাই একবারে হতাশ নই। এ সমস্যার সমাধানে প্রশিক্ষিত ও মেধাবী তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। সদিচ্ছা থাকতে হবে। শুধু দেশকে নয়, বিশ্বকে কীভাবে সেরা কাজ উপহার দেব সেই চেষ্টা নিয়ে নতুন করে এগুতে হবে। কারণ ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণে কোনো উপাদান বা উপকরণের অভাব আমাদের নেই। এর সঙ্গে সততা আর সদিচ্ছার সংমিশ্রণ ঘটাতে পারলেই আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র।

 

অবসর সময় কাটে কীভাবে?

ঘরের কাজ করি। ছেলে অনিক কানাডার ওয়াটার লু ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স শেষ করে ওখানে জব করছে। এখন পিএইচ ডি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলি। আমি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ডিসিআইআইআইয়ের বাংলাদেশের অ্যাম্বেসেডর। ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটির বড়মাপের একটি প্রোগ্রাম হবে। এর জন্য কিছু কাজ করছি। সব মিলিয়ে চলচ্চিত্র ছাড়া সব কিছু নিয়ে এখন হ্যাপি লাইফ লিড করছি। বলতে পারেন আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি নাও।

সর্বশেষ খবর