মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ফিল্ম আর্কাইভে ছবি জমাদানের আইন অমান্য

হারিয়ে গেছে কালজয়ী যত ছবি

হারিয়ে গেছে কালজয়ী যত ছবি

সংরক্ষণের জন্য ফিল্ম আর্কাইভে ছবি জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও অনেক নির্মাতাই তা মানেন না। ফলে কালজয়ীসহ অনেক ছবিই হারিয়ে গেছে নির্মাতার উদাসীনতায়। এক্ষেত্রে শাস্তিমূলক আইন থাকলেও এ পর্যন্ত এই আইনের আওতায় আনা হয়নি কোনো নির্মাতাকে। এ বিষয়ে লিখেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ফিল্ম আর্কাইভ কেন

চলচ্চিত্র হচ্ছে গণযোগাযোগের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ইতিহাসের রেকর্ড কিপারও বলা হয় চলচ্চিত্রকে। চলচ্চিত্রের এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই তা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় ফিল্ম আর্কাইভ বা ফিল্ম মিউজিয়াম। এই লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশেও ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ছবি নির্মাণের পর নির্মাতার দায়িত্ব হচ্ছে ছবির একটি কপি আর্কাইভে জমা দেওয়া। যাতে ছবিটি সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু অনেক নির্মাতাই বিনা কারণে এ নিয়ম মানেন না। ফলে হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে অনেক ছবি।

 

ফিল্ম আর্কাইভের আইন

১৯৭৮ সালে ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অনেক নির্মাতার মধ্যে ছবি জমা দেওয়া নিয়ে উদাসীনতা দেখা দেওয়া এবং প্রচুর ছবি হারিয়ে যাওয়ায় এ ক্ষেত্রে আইন করতে সরকার বাধ্য হয়। ২০০৫ সালের কপিরাইট অ্যাক্টে বলা আছে, ছবি নির্মাণের পর সংরক্ষণের জন্য অবশ্যই সেই ছবির একটি কপি নির্মাতাকে ফিল্ম আর্কাইভে জমা দিতে হবে। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট নির্মাতার দুই বছরের জেল এবং একই সঙ্গে ৫০ হাজার টাক অর্থদণ্ড করা হবে। ফিল্ম সেন্সর বোর্ডকে বলা হয়েছে, ছবি সেন্সরের পর নির্মাতাকে আর্কাইভে ছবির কপি জমা দেওয়ার জন্য বলা হবে এবং ওই নির্মাতা আগে কোনো ছবি নির্মাণ করে থাকলে তা আর্কাইভে জমা দেওয়া হয়েছে মর্মে কাগজপত্র দেখাতে হবে।

 

আর্কাইভ এবং সেন্সর বোর্ডের বক্তব্য

ফিল্ম আর্কাইভ সূত্রে জানা গেছে, কিছু নির্মাতা তাদের ছবি জমা দেন না তাদের কাছে একাধিকবার চিঠি দিয়ে ও সরাসরি লোক পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। ২০০৫ সালের আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে যারা এ পর্যন্ত ছবি জমা দেননি তাদের তালিকা করা হচ্ছে। এসব নির্মাতার কাছে শিগগিরই চিঠি পাঠানো হবে। অন্যদিকে সেন্সর বোর্ডকেও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেন্সর বোর্ড জানায়, নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও অনেক নির্মাতা ছবি জমা দেন না। অনেকে আবার ছবি মুক্তির পর তা অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেন। ফলে যারা কিনছেন তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য না থাকায় সংশ্লিষ্ট নির্মাতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তবে এ ব্যাপারে এখন বোর্ড কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে।

 

ফিল্ম আর্কাইভ ডিজির বক্তব্য

ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর হেসেন বলেন, ছবি জমাদান নিশ্চিত করতে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে সম্প্রতি একটি নির্দেশনা এসেছে। ইতিমধ্যে ছবি জমা দেননি এমন অনেক নির্মাতার কাছে রিমাইন্ডার দিয়ে পত্র প্রেরণ শুরু হয়েছে। অনেকে ছবি জমা দেওয়া শুরুও করেছেন। একই সঙ্গে এ বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপের জন্য সেন্সর বোর্ডকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে যারা আইন মানবেন না তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

নির্মাতাদের বক্তব্য

২০১৩ সালে ডিজিটাল ফরমেটে ছবি নির্মাণ শুরু হলে কোনো নির্মাতাই আর্কাইভে ছবি জমা দিতে আগ্রহ দেখাননি। এমন নির্মাতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন— জাজ মাল্টিমিডিয়ার আবদুল আজিজ এবং রেদোয়ান রনি, মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ, শিহাব শাহীন প্রমুখ। আবদুল আজিজ বলেন, আর্কাইভ যে ফরমেটে ছবি জমা দিতে বলে অর্থাৎ হার্ড ড্রাইভ বা হার্ড ডিস্ক তা নিরাপদ নয়। বলা যায় উন্মুক্ত এই পদ্ধতিতে ছবি জমা দিলে তা কপি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে নিরাপত্তার অভাবে জাজ কোনো ছবি জমা দেয় না। আর্কাইভ যদি ফরমেট বদলায় তাহলে অবশ্যই জমা দেওয়া হবে। শিহাব শাহীন বলেন, আসলে নানা ব্যস্ততার কারণে মনে না থাকায় অনেকের মতো আমিও আমার ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ ছবিটি জমা দিতে পারিনি। তা ছাড়া ছবি জমা দেওয়ার নিয়ম এবং এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা কেউ দেয় না বলেই এটি আর হয়ে ওঠে না।

 

যেসব ছবি কখনই আর দেখা যাবে না

নির্মাতার অসচেতনতার অভাবেই অনেক ছবি জমা হয়নি আর্কাইভে। ফলে বহু কালজয়ী ছবি চিরতরে হারিয়ে গেছে। যার অস্তিত্ব কোথাও নেই।

এমন ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে— এহতেশাম পরিচালিত ‘চান্দা’ এবং ‘চাঁদনী’, ‘রাজধানীর বুকে’, এস এম শফীর ‘দ্য রেইন’, দিলীপ বিশ্বাসের ‘অংশীদার’, নায়করাজ রাজ্জাকের ‘অনন্ত প্রেম’, ইবনে মিজানের ‘জিঘাংসা’। ষাটের দশকের ‘আকাশ আর মাটি’, ‘রাজা এলো শহরে’, মহিউদ্দীনের ‘মাটির পাহাড়’ ছবিরও কোনো প্রিন্ট নেই।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এহতেশাম পরিচালিত ‘চাঁদনী’ ছবির প্রযোজক ছিলেন বেক্সিমকোর একজন  পরিচালক। তার অজান্তা কথাচিত্র ছবিটি আর্কাইভে জমা দেননি। নায়করাজ রাজ্জাক তার নির্মিত ছবিগুলো শেখ ফরিদ নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেওয়ায় রাজ্জাকের রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশনের কোনো ছবির ৩৫ মিমি রিল আর্কাইভে জমা পড়েনি। শাবানার এস এস প্রোডাকশনের কোনো ছবিও জমা পড়েনি আর্কাইভে। সাইফুল আজম কাশেমও তার মেট্রো ফিল্মসের সোহাগ, বৌরানী, ঘর সংসারসহ কোনো ছবি জমা দেননি। ইলিয়াস কাঞ্চন প্রযোজিত কোনো ছবি নেই আর্কাইভে। নায়ক আলমগীর জমা দেননি তার বৌমা, মায়ের দোয়াসহ নিজের নির্মিত কোনো ছবি। আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড জমা দেয়নি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘স্বজন’, ‘আমার ঘর আমার বেহেশত, ‘অগ্নি সাক্ষী’র মতো জনপ্রিয় ছবিগুলো। মুস্তাফিজের কালজয়ী ছবি ‘তালাশ’রও কোনো প্রিন্ট নেই আর্কাইভে। এস এম শফী তার বিখ্যাত ‘দি রেইন’ ছবিটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন পাঁচবিবি সিনেমা হলের মালিক ইদরিসের কাছে। তিনি ছবিটি আর্কাইভে জমা দেননি। এফডিসিতে এর একটি নেগেটিভ থাকলেও সংরক্ষণের অভাবে তা এক সময় নষ্ট হয়ে যায়। দিলীপ বিশ্বাসের গীতি চিত্র কথার ‘অপেক্ষা’ আর গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ছাড়া তাদের আর কোনো ছবি নেই আর্কাইভে। জেড এ ফিল্মস, পারভেজ ফিল্মস, ছায়াবাণী, নারায়ণ ঘোষ মিতার রূপবাণী, জসিমের জেম্বস প্রোডাকশনেরও কোনো ছবি নেই ফিল্ম আর্কাইভে।

গুলিস্তান বিল্ডিংয়ে এক সময় বেশির ভাগ ছবি প্রযোজনা সংস্থার অফিস ছিল। নব্বইয়ের দশকে সেখানে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অসংখ্য কালজয়ী ছবি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অথচ ফিল্ম আর্কাইভে জমা থাকলে এভাবে ধ্বংস হয়ে যেত না ছবিগুলো।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর