শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

অনলাইননির্ভর অডিও ইন্ডাস্ট্রি

কলের গানের পর অডিও টেপ। ক্যাসেট প্লেয়ারের পর সিডি-ডিভিডি। আর এখন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি হয়ে পড়েছে অনলাইননির্ভর। ইউটিউবসহ বিভিন্ন ডিজিটাল পোর্টাল, অ্যাপস ও সাইটে চলছে গানের প্রচার-প্রচারণা ও আনুষ্ঠানিক প্রকাশ। মিউজিকের এই ধারাবদলে শিল্পীরাও সচেতন হয়েছেন তাদের নিজেদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের ক্ষেত্রে। সেখান থেকে মিলছে আয়ও। এসব নিয়ে কী ভাবছেন সিনিয়র শিল্পীরা? জানাচ্ছেন— আলী আফতাব

 

আগের মতো ক্যাসেট প্লেয়ার বাজিয়ে এখন আর গান শোনা হয় না। কম্পিউটার কিংবা অন্য ডিভাইসে সিডির সহযোগিতায় গান শোনার অভ্যাসটাও ভুলতে বসেছেন শ্রোতারা। এর প্রভাবটা পড়েছে দেশের অডিও বাজারে। এ বছর প্রকাশিত গানের ৮০/৮৫ ভাগই প্রকাশ হয়েছে ডিজিটাল ভার্সন অর্থাৎ অনলাইনে। যাকে অনেকেই মনে করছেন সিডি বিলুপ্তির ইঙ্গিত। গান প্রকাশে অনলাইন বেছে নেওয়ার কারণে দেশের বেশির ভাগ সিডির দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। ইউটিউব হয়ে উঠেছে গান শোনার সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় মাধ্যম। পাশাপাশি মোবাইলেও গান শুনছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শ্রোতা।

এই ধারায় শুধু নবাগত শিল্পীরাই নন, এদেশের প্রথিতযশা শিল্পীরাও ইউটিউবে গান রিলিজ করছেন। এ ছাড়া ইউটিউবে এখন গানের ক্ষেত্রে নতুন শিল্পীদের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থাও জোর দিচ্ছে নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলে। আবার অ্যাপস, গান কার্ডসহ আরও নতুন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম দেখা যাচ্ছে। তবে সংগীতবোদ্ধারা মত দিয়েছেন— ডিজিটাল ভার্সনে প্রকাশ পেলেও কিছু সিডি যেন প্রকাশ করা হয়। অনলাইনে গান প্রকাশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশের গুণী কিছু শিল্পীর।

 

‘অনলাইন নীতিমালা মানছে না কেউই’

— মনির খান

আগে কত কপি অ্যালবাম বিক্রি হতো তা চোখে দেখা যেত বা তার সঠিক তথ্য জানা যেত। কিন্তু এখন ডিজিটাল কারচুপির কারণে তা ধরা যাচ্ছে না। কারণ দেখা গেল, আমার একটি গান ২০টি অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। এর থেকে কি করে সঠিক তথ্য পাব আমি। কিন্তু অনলাইন নীতিমালায় বলা আছে, কারও অনুমতি ছাড়া অনলাইনে কোনো শিল্পীর গান দেওয়া যাবে না। কিন্তু এই নীতিমালা কেউ মানছে না। আমাদের সব শিল্পীর উচিত তার নিজেদের গানগুলো কপি রাইট করে নেওয়া। আর সিডি কিনে গান শোনার অভ্যাসটা ঠিক রাখলেই বরং ভালো হয়।

 

‘আধুনিকতা মানে এই নয়, যা খুশি তাই করব’

— ফাহমিদা নবী

প্রতিটি মানুষের মধ্যেই ভালো-মন্দ দুটি দিক আছে। আমরা এখন যা মন চাচ্ছে তাই করছি। আধুনিকতার যুগে গান প্রচারের শক্ত মাধ্যম হচ্ছে অনলাইন। আর ইউটিউব হচ্ছে গান প্রকাশের মাধ্যম। এখানে অনেকে যা মন চাচ্ছে তাই দিয়ে দিচ্ছে। এটা ঠিক নয়। রেকর্ড-ক্যাসেট-সিডি-ডিভিডির পালা শেষ গান চলে এসেছে অনলাইনে। সময়ের সঙ্গে চলতে হলে আমাদের আধুনিক হতে হবে। তার মানে এই নয় যে, গান নিয়ে যা খুশি তাই করব। আমি মনে করি গানের প্রয়োজনে মিউজিক ভিডিও হয়। কিন্তু এখন দেখছি তার উল্টো।

 

‘নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শক-শ্রোতা দিয়ে কেউ জনপ্রিয় হতে পারেন না’

— কুমার বিশ্বজিৎ

আমাদের আধুনিকতার সঙ্গে চলতে হবে। আর বর্তমানে মিউজিক ভিডিও প্রচারণায় ইউটিউব একটি শক্ত মাধ্যম।     আমি বলতে চাই আমাদের মাধ্যমটা ঠিক আছে, কিন্তু মূল বিষয়টি ঠিক নেই। আর মূল বিষয়টি হচ্ছে গান। ভালো গান না করে অনেক টাকা খরচ করে মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করে কী হবে। সবার আগে গানটা জরুরি।

আমাদের বুঝতে হবে অনলাইনে কারাগান শুনে। কারা ইউটিউব ব্যবহার করে। আমরা জানি একটি নির্দিষ্ট বয়সের দর্শক-শ্রোতারা ইউটিউব ব্যবহার করে। এই নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শক-শ্রোতা দিয়ে কেউ কোনো দিন জনপ্রিয় হতে পারেন না।

এ ছাড়া এখন টাকা দিয়ে বুস্ট করে মিউজিক ভিডিওর ক্লিক বাড়ানো যায়। শেয়ার, ভিউ আর সাবস্ক্রাইবার সবই বাড়ানো যায়। আমি মনে করি এটি শুধুই আত্মতৃপ্তি। আমার নব্বই শতাংশ গানের এখনো কোনো মিউজিক ভিডিও হয়নি। তাই বলে আমার গান কি জনপ্রিয় নয়? তাই সবার আগে গানের দিকেই মনোযোগী হওয়া দরকার।

 

‘অনলাইন নীতিমালা মেনে চলা উচিত’

— রিজিয়া পারভীন

আধুনিকতা সব ক্ষেত্রেই ছাপ রেখেছে। অনলাইনে গান চলে আসার ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। ভালো দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে, কোনো গান অনলাইনে প্রকাশ হওয়া মানে সারা বিশ্বে গানটি ছড়িয়ে যাওয়া। খুব সহজে যে কেউ গানটি শুনতে পাবে। আর মন্দ দিক হচ্ছে, অনলাইনে গান প্রকাশের ফলে অনেক শিল্পী তার গানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। অডিও কোম্পানিগুলোও আমাদের সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। আর তাই শিল্পীরা টিকে থাকার জন্য একটি একটি গান করে আর তা অনলাইনে প্রকাশ করে। আর বেঁচে থাকার জন্য শিল্পীরা হয়ে পড়ছেন স্টেজনির্ভর। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়, আমাদের সঠিক অনলাইন নীতিমালা মেনে চলা। এমনভাবে সবকিছু গড়ে তোলা উচিত যাতে করে একজন শিল্পী যেন তার অর্জন থেকে বঞ্চিত না হন।

 

‘শিল্পীরা অনলাইনে টাকা দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন’

— ডলি সায়ন্তনী

অনলাইনে গান প্রকাশ সময়ের চাহিদা মাত্র। এখন কেউ যদি আমাকে বলে, আপা আপনার একটি গান এত লাখ ভিউয়ার হয়েছে, এত হাজার শেয়ার হয়েছে, এই নিয়ে আমার মনের ভিতর কোনো প্রকার অনুভূতি কাজ করে না। কিন্তু একটা সময় অডিও দোকানদার আমাদের যখন বলত, আপা আজ এত কপি অ্যালবাম বিক্রি হয়েছে। এই কথাটা শুনতে দারুণ ভালো লাগত। ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা জাগত। এখন আর সেটা কাজ করে না। এখন গান চলে গেছে অনলাইনে। এখনকার শিল্পীরা অনলাইনে টাকা দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। এগুলো কখনোই জনপ্রিয়তা কিংবা কাজের মানদণ্ড হতে পারে না। এখনো যখন নতুনদের সঙ্গে গান গাইতে মঞ্চে উঠি তখনই আসল জনপ্রিয়তা বোঝা যায়। গান যে মাধ্যমেই প্রকাশ হোক না কেন। তা ভালো কিছু হওয়া চাই।

সর্বশেষ খবর