বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

জীবন মঞ্চের পর্দা নামল তার...

আলাউদ্দীন মাজিদ

জীবন মঞ্চের পর্দা নামল তার...

মিজু আহমেদ জন্ম : ১৭ নভেম্বর ১৯৫০ — মৃত্যু : ২৭ মার্চ ২০১৭

অভিনয় করতে করতেই ৪০ বছরের অভিনয় জীবনের যবনিকাপাত ঘটল শক্তিমান অভিনেতা মিজু আহমেদের। সোমবার সারাদিন ‘অহংকার’ ছবির শুটিং করলেন। পরদিন মানে মঙ্গলবার দিনাজপুরে ‘মানুষ কেন অমানুষ হয়’ ছবির শুটিং। আর এর জন্য সোমবার রাত ৮টার দিকে কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চড়লেন। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ যাত্রার ঘণ্টা বেজে উঠল। হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলেন তিনি। মুহূর্তেই নিভে গেল জীবন প্রদীপ। তার জীবন মঞ্চের পর্দা নামল। সদা হাস্যোজ্জ্বল শক্তিমান এই অভিনেতাকে আর কেউ এই ধরাতে দেখতে পাবে না। তাকে আর দেখা যাবে না তুখোড় অভিনয় দিয়ে দর্শক মন ভরাতে। ১৯৫০ সালে কুষ্টিয়ার কোর্টপাড়ায় জন্মগ্রহণ করা মিজানুর রহমান ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি দুর্বল ছিলেন। ছাত্র অবস্থাতেই যোগ দিলেন কুষ্টিয়া থিয়েটারে। মঞ্চ নাটকে সাড়া জাগালেন। বন্ধুরা তাকে বলত তুমি চলচ্চিত্রে যাও, সহজেই নাম করতে পারবে। অন্যদের মুখ থেকে কথাটি শোনার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন তিনি। বড় পর্দায় কাজের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৭ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে ছুটে এলেন ঢাকায়। সুযোগও পেয়ে গেলেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রয়াত নারায়ণ ঘোষ মিতা তখন ফারুক আর কবরীকে নিয়ে ‘তৃষ্ণা’ শিরোনামের ছবিটি নির্মাণ করতে যাচ্ছিলেন। এতে একটি অ্যান্টি ক্যারেক্টারের প্রয়োজন ছিল। নায়ক ফারুকের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল মিজানুর রহমানের। তিনি মিতাকে বললেন এই ছেলেটিকে দেখতে পারেন।  মিজানুর রহমানকে দেখে ও অভিনয়ের প্রতি তার আগ্রহের কথা শুনে তাকেই চরিত্রটি দিয়ে দিলেন মিতা। প্রথম ছবিতেই বাজিমাৎ। অসাধারণ অভিনয় দিয়ে উের গেলেন তিনি। চলচ্চিত্রে এসে মিজানুর রহমান হয়ে গেলেন খল অভিনেতা মিজু আহমেদ। সত্তরের দশক থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বড় পর্দায় তার চাহিদা ছিল আকাশ ছোঁয়া। নির্মাতাদের কথায় ছবিতে ‘মন্দ লোক’-এর চরিত্রের কথা ভাবলেই মনে এসে যায় মিজু আহমেদের কথা। কী অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা। পর্দায় মন্দলোক হয়ে দর্শকের ক্রোধের সীমা ছাড়িয়ে দিতেন তিনি। এখানেই ছিল তার অভিনয়ের সার্থকতা। আর এজন্য একাধিক বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বিভিন্ন সংগঠনের সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। জয় করে নেন দর্শক হৃদয়। অভিনয় করে গেছেন দুই শতাধিক ছবিতে। শিল্পীরা তাকে ভালোবেসে শিল্পী সমিতির সভাপতির আসনেও উপবিষ্ট করিয়েছিলেন। মিজু আহমেদ শুধু একজন বলিষ্ঠ অভিনেতাই ছিলেন না। দক্ষ মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করতে অবলীলায় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি।

‘মৃত্যুই শেষ কথা’

মৃত্যু চির সত্য, এটিই শেষ কথা। আর এই অমোঘ নিয়মে মিজুও চলে গেল। সবাইকে চলে যেতে হবে। তার সঙ্গে বেশ কটি ছবিতে কাজ করেছি। তার অভিনয় দক্ষতা সত্যিই চোখে পড়ার মতো ছিল। আরেকজন মিজু আহমেদ আর কখনই আসবেন না। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। পরিবারের প্রতি রইল সমবেদনা।

‘একে একে সবাই চলে যাচ্ছেন’

কয়েক বছরে একে একে অনেক শিল্পী চলে গেলেন। তাদের শূন্যতা বড় বেদনা দেয়। জানি  সবাইকে  চলে যেতে হবে। এই চির বিদায়ের ব্যথা বড় কঠিন। মিজু ভাইয়ের মতো একজন দক্ষ অভিনেতা চলে গেলেন। তার শূন্যস্থান কখনো পূরণ হবার নয়। তার আত্মা শান্তিতে থাকুক, তার পরিবারকে বিধাতা এই শোক সহ্য করার শক্তি দেবেন এই প্রার্থনা আমার।

‘ওকে ছবিতে আমিই নিয়ে আসি’

মিজু আহমেদ মালিটোলায় থাকত। ওর হাঁটাচলা, চাহনি আর ভাব-ভঙ্গিমায় কেমন যেন অভিনেতার ছাপ খুঁজে পেতাম। ওই সময় নারায়ণ ঘোষ মিতা আমাকে নিয়ে ‘তৃষ্ণা’ নামের একটি ছবি নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন। এতে একটি দুষ্ট ছেলের চরিত্র ছিল। আমি মিতা ভাইকে মিজুর কথা বললাম। তিনি তাকে দেখে পছন্দ করলেন। অসাধারণ অভিনয় করল সে।

 

‘মিজু ভাইয়ের স্থান পূরণ হবে না’

মিজু ভাইয়ের মতো দক্ষ অভিনেতার শূন্যস্থান কখনই পূরণ হবার নয়। রাজীব, হুমায়ুন ফরীদি, মান্না, জসিম, সালমানসহ যারা চলে গেছেন তাদের স্থান কী কেউ কখনো পূরণ করতে পেরেছে। একজন ভিলেন হিসেবে মিজু ভাই দর্শকদের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারত তা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।

তার শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়।

 

এফডিসিতে অশ্রুসিক্ত বিদায়...

সোমবার রাতে যখন তার মৃত্যুর সংবাদ এফডিসিতে এসে পৌঁছল তখন পুরো এফডিসি যেন মুহূর্তেই থমকে গেল। অনাকাঙ্ক্ষিত খবরে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল চলচ্চিত্র পাড়া। কারও বিশ্বাস হচ্ছিল না এমন হাসিখুশি জলজ্যান্ত একজন মানুষ যিনি কিনা দিনভর চলচ্চিত্রের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন তিনি কীভাবে এত সহজে চির বিদায়ের পথে হাঁটবেন। গতকাল বেলা প্রায় ১১টায় যখন মিজু আহমেদের মরদেহ এফডিসিতে এসে পৌঁছে তখন চারদিকে ছিল সতীর্থদের চাপা কান্নার আওয়াজ। জানাজা শেষে অশ্রসিক্ত বিদায়ে কুষ্টিয়ার নিজ জন্মভূমিতে চলে গেলেন সবার প্রিয় এই অভিনেতা। সেখানে কোটপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

 

মিজুর কথাই সত্যি হলো—ছটকু আহমেদ

২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গভবনে আমি ও আমার স্ত্রী যাই। সেখানে মিজু আহমেদও তার সহধর্মিণীকে নিয়ে আসেন। সম্প্রতি মিজু ভাই আমার ‘এক কোটি টাকা’ ছবিতে অভিনয় করছিলেন।  মিজু ভাই আমাকে বলেন, ছটকু ভাই এই ছবির কাজ মনে হয় সহজে শেষ হবে না। আটকে যাবে। আমি তার কথায় হতচকিত হয়ে উঠি। তাকে বলি কি যে বলেন, ছবির কাজ আটকে যাবে কেন? তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অবাক হয়ে যাই। তাহলে কী তিনি জানতেন তার চির বিদায়ের সময় আসন্ন।

 

কাজী হায়াতের সঙ্গে শেষ কথা...

মৃত্যুর আগে মিজু আহমেদ শেষ কথা বলে গেলেন কাজী হায়াতের সঙ্গে। দুজনের একসঙ্গে দিনাজপুরে ‘মানুষ কেন অমানুষ হয়’ ছবির শুটিংয়ে অংশ নিতে যাওয়ার কথা। কাজী হায়াৎ বলেন, আমি ফকিরাপুলে একটি কাজে গিয়ে আটকা পড়ে যাই। স্টেশনে পৌঁছে মিজু আমাকে ফোন দেয়। আমাকে বলেন, ‘আপনি কোথায়? আমি ট্রেনে উঠছি, তাড়তাড়ি চলে আসেন।’ আমি যখন কমলাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছাই তখন ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। আমি মিজুকে কয়েকবার ফোন দেই। ও ফোন রিসিভ করেনি। কিছুক্ষণ পর ওর ফোন থেকে কল আসে। কে একজন বলেন, আপনি কে? আমি পরিচয় দিলে তিনি জানান, মিজু সাহেব আর বেঁচে নেই। হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন তিনি। কাউকে এয়ারপোর্ট স্টেশনে পাঠিয়ে দিন। সেখানে তার মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হবে। আমি নির্বাক হয়ে শুধু শুনে গেলাম। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। তিনি হঠাৎ এভাবে চলে যাবেন তা কী করে হয়।

রাজাকার হতে হলো না তাকে

দিনাজপুরে যাচ্ছিলেন ‘মানুষ কেন অমানুষ হয়’ ছবির শুটিংয়ে অংশ নিতে। এই ছবিতে তার চরিত্র ছিল একজন রাজাকারের। প্রথমে এমন চরিত্রে অভিনয় করতে চাননি তিনি। পরে ভাবলেন একজন অভিনেতাকে সব ধরনের চরিত্রেই কাজ করতে হয়। তাই রাজি হলেন। শেষ পর্যন্ত তার অনিচ্ছারই জয় হলো। তাকে আর রাজাকারের চরিত্রে অভিনয় করতে হলো না।

 

মৃত্যুর পর প্রথম যাত্রা এফডিসির পাশ দিয়েই...

কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনে উঠেই চিরবিদায় নিলেন মিজু আহমেদ। তার লাশ নিয়ে ট্রেন ছুটে চলল। পথে এফডিসির পাশ ঘেঁষেই ট্রেন চলে গেল। প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে নীরবে মনে হয় কেঁদেছিল মিজু আহমেদের এই দ্বিতীয় বসত বাড়িটি।

 

স্বপ্নপুরীতে আর যাওয়া হলো না তার

কথা ছিল দিনাজপুরের স্বপ্নপুরীতে যাবেন। অভিনয় করবেন ‘মানুষ কেন অমানুষ হয়’ ছবিতে। নিয়তির অমোঘ বিধান। আর স্বপ্নপুরীতে যাওয়া হলো না।  চিরতরে চলে গেলেন মৃত্যুপুরীতে। তার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল।

সর্বশেষ খবর