মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঢাকার সিনেমা হলের চালচিত্র

ঢাকার সিনেমা হলের চালচিত্র

শো শুরু হতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। অথচ খাঁ খাঁ করছে গোটা হল!

নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ৪৪টি। বর্তমানে ঢাকা শহরে সিনেমা হল আছে ২৬টি। দর্শকের অভাবে একের পর এক বন্ধ হয়েছে সিনেমা হলগুলো। সর্বশেষ গত এপ্রিলে বন্ধ হয়ে গেছে কাওরান বাজার এলাকার ‘পূর্ণিমা’ সিনেমা হলটি। ঢাকায় বর্তমানে যে ২৬টি সিনেমা হল চালু আছে তাতে দর্শকের অভাব চোখে পড়ার মতো। আরও কিছু হল চলছে ধুঁকে ধুঁকে। ঢাকার সিনেমা হলগুলোর বর্তমান চালচিত্র তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ঢাকার সিনেমা হলগুলোর ব্যবসায়িক চিত্র এখন খুব একটা সুখকর নয়। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে— চিত্রামহল, সনি, এশিয়া, মধুমিতা, অভিসার ও বলাকায় দর্শক তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ হিসেবে দেখা যায় এসব সিনেমা হলে পরিবেশ অনেকটা ভালো এবং এগুলোতে ঠিকভাবে ছবি প্লেস করা হয়। অন্যদিকে আনন্দ, সঙ্গীতা, ছন্দ, সুরমা, নেপচুনসহ বাকিগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। দর্শকের অভাবে এগুলো এখন বন্ধের পথে। চলতি সপ্তাহে আনন্দ সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে ‘মিলন সেতু’ নামের একটি ছবি। ছবিটি দেখতে প্রতিদিন দর্শক আসেন ২৫ থেকে ২৬ জনের মতো। ১১১৪ আসনের এই সিনেমা হলটির ব্যবস্থাপক শামসুল আলম উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, এ ধরনের মানহীন ছবি নির্মাণ হলে দর্শক সিনেমা হলে আসতে বিরক্ত বোধ করে। আর এমন ছবির কারণেই সিনেমা হল দর্শকশূন্য ও বন্ধ হচ্ছে। সিনেমা হলের অনুন্নত পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দর্শক নেই, তারপরেও স্টাফদের বেতন, ইলেকট্রিক, পানির বিল, বিভিন্ন ট্যাক্স নিয়মিত পরিশোধ করতে হয়। লোকসান গুনে এসব শোধ করার পর কীভাবে সিনেমা হল সংস্কার করা যাবে। ছন্দ সিনেমা হলে আসন ছিল ৪৮২টি। সিট ভাঙতে ভাঙতে এখন এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫০টির মতো। এগুলোও পূর্ণ হয় না। দৈনিক গড়ে দর্শক হয় ২৫ জনের মতো। তার প্রশ্ন ধার-দেনা করে এভাবে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখার কোনো যুক্তি কী আছে? অন্যান্য সিনেমাহলেরও একই চিত্র এবং হল মালিকদের ক্ষোভ আর উদ্বেগজড়ানো প্রশ্ন-দর্শকশূন্য সিনেমা হল রেখে আর লাভ কী?

 

 যে কারণে দর্শক হারিয়েছে সিনেমা হল

এক সময় ঢাকায় সিনেমা হলের ঐতিহ্য ও ইতিহাস ছিল সমৃদ্ধ। ১৯২৭ সালে রাজার দেউড়িতে প্রথম নির্মাণ হয় ‘কমলা টকিজ’ পরে যা ‘প্যারাডাইস সিনেমা’ নামে পরিচিত হয়। ১৯৩২ সালে ইসলামপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘লায়ন থিয়েটার’। পরে এর নাম হয় ‘লায়ন সিনেমা’। শুধু উৎসবে নয়, সারা বছর দর্শক সপরিবারে আনন্দঘন পরিবেশে সিনেমা হলে যেত।   দর্শক চাহিদায় নব্বই দশক পর্যন্ত ৪৪টি সিনেমা হল নির্মাণ হয় ঢাকায়। সারা দেশে এ সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তেরোশ’। সিনেমা হল বাড়লেও বেশিরভাগ সময়ই টিকিট পাওয়া যেত না হলগুলোতে। হলের সামনে ঝুলতো ‘হাউস ফুল’ লেখা সাইনবোর্ড। আজ সেই সোনালি সময় আর নেই। নব্বই দশকের শেষ ভাগে এসে নানা অবক্ষয়ের কারণে সিনেমা হলের এই রমরমা অবস্থার ধস নামে। একের পর এক বন্ধ হতে থাকে হলগুলো। নোংরা পরিবেশ আর মান্ধাতার আমলের চলচ্চিত্র প্রদর্শন ব্যবস্থার কারণেই মূলত দর্শক হারিয়েছে সিনেমা হল। বর্তমানে সারা দেশে সিনেমা হল আছে ২৮০টির মতো। দুই ঈদে মৌসুমি সিনেমা হল হিসেবে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২০-এ।

 

ঢাকায় সিনেমা হলের বর্তমান সংখ্যা

বর্তমানে ঢাকায় আছে ২৬টি সিনেমা হল। এগুলো হলো— আজাদ, চিত্রামহল, মানসী, অভিসার, নেপচুন, গীত, সংগীত, জোনাকী, রাজমণি, রাজিয়া, পদ্মা, সুরমা, গ্যারিসন, শাহীন, সনি, পুরবী, এশিয়া, পর্বত, মুক্তি, শ্যামলী, বিজিবি অডিটোরিয়াম, বলাকা,  আনন্দ, ছন্দ, পুনম ও মধুমিতা।

 

বন্ধের তালিকায় আছে যেসব হল

অনুসন্ধান করে জানা গেছে দর্শকের অভাবে অচিরেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে যেসব সিনেমা হল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো— আজাদ, মানসী, আনন্দ, অভিসার, আগমন ও রাজমণি।

 

সিনেমা হল মালিকদের কথা

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি মধুমিতা সিনেমা হলের অন্যতম কর্ণধার ইফতেখার নওশাদ বলেন, চাহিদা অনুযায়ী এবং মানসম্মত ছবি না পাওয়া গেলে সিনেমা হলের যতই উন্নয়ন করা হোক না কেন কোনোভাবেই সিনেমা হলের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বছরে দুই ঈদ ও পহেলা বৈশাখ ছাড়া এখন অন্য কোনো সময় দর্শক সিনেমা হলে আসেন না বললেই চলে। কারণ এসব উৎসবেই শুধু কিছুটা গুণগতমানের ছবি পাওয়া যায়। এ অবস্থায় কীভাবে হল টিকিয়ে রাখব।

প্রদর্শক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, সিনেমা হল বন্ধ রোধ, নতুন হল নির্মাণ তখনই সম্ভব হবে যখন চাহিদামতো ছবি পাওয়া যাবে। অনেক দিন ধরে স্থানীয়ভাবে মানসম্মত ছবি নির্মাণ হচ্ছে না। তাই দর্শক এখন সিনেমা হলবিমুখ। সিনেমা হল বা এ ব্যবসা বাঁচাতে অবাধে বিদেশি ছবি প্রদর্শন এবং দেশীয় ভালো ছবি নির্মাণ করতে হবে। না হলে সরকারি অনুদান বা যেভাবেই হোক সিনেমা হল নির্মাণ করে লাভ নেই। লোকসান গুনতে গুনতে এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হওয়া লায়ন সিনেমার কর্ণধার মির্জা আবদুল খালেক বলেন, ছবির অভাবে আমার সিনেমা হলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। মাঝে মধ্যে চলার মতো দু-একটি ছবি পেলেও দেখার মতো ছবির অভাবে দর্শক আর সিনেমা হলে আসছেন না। তাই যৌথ প্রযোজনা, বিদেশি ছবি আমদানি এবং মানসম্মত দেশি ছবি নির্মাণ ছাড়া সিনেমা হল বাঁচানোর আর কোনো পথ নেই। নাটক মার্কা ছবি নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। একটি সিনেমা হল চালাতে মাসে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা ব্যয় হয়। তাই সরকারি অনুদান দিয়ে সিনেমা হল সংস্কার বা নির্মাণ করে কোনো লাভ নেই। আর যে পদ্ধতিতে সরকার অনুদান দিতে যাচ্ছে তা ভুল। এতে অনুদানের এককালীন এই টাকার অপচয়ই শুধু হবে। আর কিছু নয়। সরকার অনুদানের জন্য যে কমিটি তৈরি করেছে তা যথার্থ হয়নি। বিষয়টি এমন ছিল সরকার যাদের চোখের সামনে দেখেছে তাদের নিয়েই আলাপে বসে গেছে। অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞদের ডাকার আর প্রয়োজন মনে করেনি। এভাবে সিনেমা হল বাঁচানো যাবে না।

সর্বশেষ খবর