চরম অস্থিরতার মুখে পড়েছে চলচ্চিত্রশিল্প। আর এ অবস্থার সৃষ্টি যৌথ প্রযোজনার ছবিকে কেন্দ্র করে। ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার দুই ছবি ‘বস টু’ ও ‘নবাব’ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন চলচ্চিত্রজগতের লোকজন। এ নিয়ে আন্দোলন, হামলা, বয়কটসহ নানা ঘটনা চলচ্চিত্রজগেক রীতিমতো অস্থিতিশীল করে তুলেছে। সর্বশেষ চলচ্চিত্র ঐক্যজোট শাকিব খান ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আবদুল আজিজকে নিষিদ্ধ ও অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। আরও জানাচ্ছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ
যৌথ প্রযোজনার দুই ছবি ‘নবাব’ ও ‘বস-টু’ যাতে ছাড়পত্র না পায় সেজন্য ১৮ জুন থেকে আন্দোলন চালিয়ে আসছিল চলচ্চিত্র ঐক্যজোট। তাদের কথা, নীতিমালা সঠিকভাবে মানা হয়নি এসব ছবির ক্ষেত্রে। বুধবার ছবি দুটির সেন্সর করার প্রস্তুতি চলাকালে জোটের রোষানলে পড়েন সেন্সর বোর্ড সদস্য ইফতেখার নওশাদ। ছবি দুটি সেন্সর ছাড়পত্র পেলে জোট শুক্রবার বিকালে পরিচালক সমিতির কার্যালয়ে জরুরি সভা করে। সভায় তথ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবিসহ শাকিবকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে প্রিভিউ বোর্ডের সদস্যপদ ছাড়েন মুশফিকুর রহমান গুলজার। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যে উঠে এসেছে এর নানা দিক।
প্রযোজক-অভিনেতা ডিপজল বলেন, ‘আমাদের জীবন থাকতে বিদেশি ছবি চালাতে দেব না, প্রয়োজনে আমার ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে ১০০ মেশিন বসাব সিনেমা হলগুলোয়। তার পরও কাউকে দেশি চলচ্চিত্রের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করতে দেব না।’
অভিনেতা রিয়াজ বলেন, ‘আমরা তথ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি। আমরা আবেগ থেকে যা-ই বলি না কেন, আমাদের চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে হলে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। আমি চাই সেন্সর বোর্ড থেকে গুলজার ভাই (মুশফিকুর রহমান গুলজার) ও দিলু ভাই (নাসির উদ্দিন দিলু) অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। তারা তা করবেন আশা করি।’
মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘আমরা দেশি চলচ্চিত্র রক্ষার আন্দোলনে নেমেছি। এ ক্ষেত্রে কারও সঙ্গে কোনো আপস নেই। কেউ যদি আমাদের চলচ্চিত্রকে অবহেলা করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। আমি নিজেও বিতর্কিত কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাই না বলে প্রিভিউ কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছি।’
খোরশেদ আলম খসরু বলেন, ‘একদিকে কেউ মনোপলি ব্যবসা করে নির্মাতাদের পথে বসাবেন, অন্যদিকে দেশি চলচ্চিত্রের স্বার্থ বিকিয়ে দেবে এ অবস্থা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক মেনে নেবে না। এতে এখন এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখে। এ অবস্থা যে কোনো উপায়ে প্রতিরোধ করতে হবে।’
সুদীপ্ত কুমার দাশ বলেন, ‘যারা দেশি চলচ্চিত্র রক্ষার জন্য মায়াকান্না করছেন তারা কেন সিনেমা হল রক্ষায় ছবি দিতে পারছেন না? এরা যদি পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি দিতে পারতেন তাহলে ১ হাজার ৩০০ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে এখন তা ২০০-এর ঘরে এসে দাঁড়াত না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নিজেরা কাজ করবে না অন্যকেও কাজ করতে দেবে না। আমার আহ্বান— আপনারা ভালো ছবি দিয়ে সিনেমা হল রক্ষা করুন। তাহলে বিদেশি ছবি আমদানি বা যৌথ প্রযোজনার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে দেশি চলচ্চিত্রশিল্পের অস্তিত্ব বিলীন হতে কখনো দেব না।’
তবে সংশ্লিষ্ট সবার আশাবাদ, শিগগিরই এ সংকট কাটিয়ে উঠবে চলচ্চিত্রাঙ্গন। কাউকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা কিংবা একে অন্যকে দোষারোপ করা নয়, বরং সত্যিকার অর্থে ইন্ডাস্ট্রি টেকানোর লড়াইয়ে নামবেন সবাই।
ফারুক
‘একদিকে আমাদের চলচ্চিত্র ধ্বংসের অপচেষ্টা অন্যদিকে সিনিয়রদের কথা না মানা, উপরন্তু তাদের খাটো করে কথা বলা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই চলচ্চিত্রশিল্পের মর্যাদা রক্ষায় যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা চলচ্চিত্রপ্রেমীরা সদা প্রস্তুত।’
আবদুল আজিজ
‘আমরা যৌথ আয়োজনের নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করিনি। প্রিভিউ বোর্ড ও সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্রই তার প্রমাণ। আসলে কিছু মানুষ হিংসার কারণে দেশি চলচ্চিত্রের স্বার্থবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। এরা আমাদের নিষিদ্ধ করার কে? শাকিব যদি আর কাজ না করেন, আর জাজ যদি ছবি নির্মাণ বন্ধ করে দেয় তাহলে সিনেমা হল কীভাবে চলবে? এ দেশে চলচ্চিত্রশিল্প বলে আর কিছু থাকবে না।’
ইফতেখার নওশাদ
‘চলচ্চিত্রশিল্পে সন্ত্রাসী কার্যক্রম কারও কাম্য নয়। যে ছবি নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে, প্রিভিউ বোর্ড তা আগেই পাস করে দিয়েছে। পরে আপত্তি তোলা মানে অপস্বার্থ। সরকারের উচিত কঠোর হওয়া। সন্ত্রাসীদের শিল্প ধ্বংসের নীলনকশা বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়া যাবে না। ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে দেশি চলচ্চিত্রশিল্পের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।’
আলমগীর
‘শাকিব খানকে আর ক্ষমা নয়। এর আগে শাকিবের ঝামেলা মিটিয়ে দিয়ে ভুল করেছিলাম। এর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ফারুক ভাইকে নিয়ে যে মন্তব্য করেছে তা ক্ষমা করা হবে না। তাকে বয়কট নয়, তার শাস্তি চাই। সংগঠনগুলো তার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেবে তাকে স্বাগত জানাব।’
মিশা সওদাগর
‘যৌথ প্রযোজনার নামে প্রতারণা চলছে। এটি আসলে আমাদের নির্মাতা-শিল্পী-কলাকুশলীদের পথে বসিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্র আস্তে আস্তে ডালপালা মেলছে। একে আর চলতে দেওয়া যায় না। এ তত্পরতা কখনই সফল হতে দেব না। দেশি চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে যারাই অবস্থান নেবেন তাদের এ শিল্পে কোনো স্থান হবে না।’
জায়েদ খান
‘অনেক অনিয়ম সহ্য করা হয়েছে। দেশি চলচ্চিত্রশিল্প রক্ষায় আর কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। যৌথ প্রযোজনার নামে এ-দেশি চলচ্চিত্রশিল্প ধ্বংসের সব তত্পরতা রোধে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। যত বড় কেউই হোন তাকে কোনো প্রকার ছাড় দেব না।’
শাকিব খান
‘আমাকে অবাঞ্ছিত বা বয়কট করার বিষয়টি হাস্যকর। আমি দেশি চলচ্চিত্রের স্বার্থবিরোধী এমন কোনো কাজ করিনি যার জন্য আমার অনুশোচনা থাকবে। নিয়ম-নীতি মেনে কাজ হয়েছে বলেই ছবি দুটি প্রিভিউ বোর্ড আর সেন্সর বোর্ডের অনুমতি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমার আর বলার কিছু নেই। আমি সিনিয়রদের সব সময় শ্রদ্ধা করি। আমি কাউকে খাটো করে কোনো কথা বলিনি। হয়তো কারও বোঝার ভুল হয়ে থাকতে পারে। আমাকে ছাড়া যদি চলচ্চিত্রশিল্প চলে তাহলে আমি স্বেচ্ছায় এ জগৎ থেকে সরে যাব।’