বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

আবার কি ফিরে পেতে পারি না চলচ্চিত্রের সোনালি দিন : শাবানা

আলাউদ্দীন মাজিদ

আবার কি ফিরে পেতে পারি না চলচ্চিত্রের সোনালি দিন : শাবানা

সত্তর আর আশির দশকে বড় পর্দায় দেখা অপরূপা, ঢালিউডের বিউটি কুইন খ্যাত জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা এখনো তেমনই সৌন্দর্যের আধার হয়ে আছেন। বয়স তাকে একটুও ছুঁতে পারেনি। ২০ বছর পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলে তাকে পূর্বের মতোই উজ্জ্বল আর উচ্ছ্বল দেখাচ্ছিল। ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী হন এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী। এরপর মিডিয়া থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন নিজেকে। এবার ঘটল ব্যতিক্রমী ঘটনা। গত মাসে ফোনে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে সাক্ষাৎকার দিলেও ১০ জুলাই বাসায় আমন্ত্রণ জানান এই প্রতিবেদককে। সৌন্দর্যের আধার আর ঢালিউডের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীকে সামনাসামনি দেখতে পাব এ কথা তার বাসায় না পৌঁছানো পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুললেন শাবানার স্বামী চলচ্চিত্রকার ওয়াহিদ সাদিক। বেশ সপ্রতিভ এবং উদার মনের মানুষ হিসেবে তার পরিচয় এখনো ঠিক তাই আছে। ড্রইং রুমে ঢুকতেই শাবানা ম্যাম এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন কেমন আছি। অবাক হয়ে তাকে দেখছি, সময় মানুষের বয়স আর সৌন্দর্য কেড়ে নেয়, বিধাতা বুঝি তার প্রতি বেশ সদয়। না হলে ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর আগের শাবানা কেমন করে একটুও বদলাননি। ড্রইং রুমে বসল গল্পের আসর। সেই আসরে আমার সঙ্গে শ্রোতা ছিলেন সাংবাদিক মনজুর কাদের, কণ্ঠশিল্পী কোনাল, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার, মহাসচিব বদিউল আলম খোকন এবং চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর। পরিচালক সমিতির পক্ষ থেকে ‘ওরা ১১ জন’ ছবির শিল্পী হিসেবে শাবানার হাতে ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শাবানা বললেন, ভাবতেও কষ্ট হয় আমাদের পরিশ্রম আর গর্বের চলচ্চিত্র শিল্প এখন দুঃসময়ে আছে। কিছুটা আনমনা হয়ে তিনি অতীতের সোনালি দিনে ফিরে যান। বলেন, আমাদের সময় অর্থের বিষয়টি মুখ্য ছিল না। শিল্পের প্রতি ভালোবাসাই বেশি কাজ করত। ঘুম, নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটি ছবি নির্মাণ হতো। দর্শকও তার প্রতিদান দিতেন। সাদরে গ্রহণ করতেন প্রতিটি ছবি। কালজয়ী সব ছবিতে সমৃদ্ধ হয়ে আছে আমাদের চলচ্চিত্র ভাণ্ডার। তার প্রশ্ন— আবার কি ফিরে পেতে পারি না চলচ্চিত্রের সেই সোনালি অতীত? শাবানা-সাদিক নিবেদিত ‘ভাত দে’ ছবিটির প্রসঙ্গ এলো আলোচনায়। ওয়াহিদ সাদিক জানালেন ছবির শুটিং করতে মানিকগঞ্জে যাই। গল্প অনুযায়ী লোকেশনও খুঁজে পাই। তারপরেও নানা সমস্যায় সেখানে শুটিং করতে অসুবিধা হবে দেখে কয়েক বিঘা জমি কিনেই ফেলি। ছবির কাজ শেষে স্থানীয়দের জায়গাটি উপহার হিসেবে দিয়ে আসি। তার কথায় এমন ত্যাগ এখন কোথায়?  আঁখি আলমগীরের এই ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে মজার তথ্য দিলেন ওয়াহিদ সাদিক। তিনি বলেন, আঁখির বাবা আলমগীর এই ছবিতে অভিনয় করেন। মেয়েকে নিয়ে তিনি শুটিংয়ে যাবেন। ছবিতে শাবানার ছোট বেলার একটি ক্যারেক্টর ছিল। ছোট্ট আঁখিকে দেখেই আমার মনে হলো এই ক্যারেক্টরের জন্য ও উপযুক্ত। আলমগীরকে বললাম ওকে দাও, এই ছবিতে অভিনয় করবে। আলমগীর রাজি হলেন না। আমি আঁখির হাত ধরে তাকে রীতিমতো আলমগীরের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে কাজ করালাম। দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে সে জাতীয় পুরস্কার জয় করল। শাবানা-সাদিক বলেন, তখনো কিন্তু আলমগীর জাতীয় পুরস্কার পাননি। শাবানাও এ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ছবিটি মোট আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় । মধুময় স্মৃতি বয়ানে হাস্যোজ্জ্বল শাবানা আর ওয়াহিদ সাদিক বলে ওঠেন, এরপর আমাদের প্রযোজিত আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘দুই পয়সার আলতা’ ছবিটি তো এ দেশের চলচ্চিত্রে আরেকটি মাইলফলক। এর একটি গান মিতালী মুখার্জির গাওয়্া ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’ যেমন জনপ্রিয় হয়েছিল তেমনি এটির দৃশ্যায়ন করতে গিয়ে শাবানাকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়েছিল। বালির মধ্যে গড়িয়ে গানটি করতে হবে। সে কি কষ্ট, দর্শক বিশেষ করে মহিলারা ছবিটি দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। গল্পের  ফাঁকে শাবানা বলে উঠলেন এবার আমরা ডিনার সেরে নেই। ডাইনিং টেবিল শাবানার হাতে রান্না করা প্রায় দেড় ডজন আইটেমে সুসজ্জিত। নিজ হাতে পরম মমতায় সবার প্লেটে খাবার তুলে দিলেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি। ওয়াহিদ সাদিক বলে উঠলেন শাবানার অতিথি আপ্যায়নে জুড়ি নেই। স্বামীর কথা শেষ না হতেই শাবানা বলে উঠলেন আমি আর কিইবা করতে পারছি। আমার বাবা চলচ্চিত্র পরিচালক ফয়েজ চৌধুরীর কাছ থেকে এই গুণটি অর্জনের চেষ্টা করেছি। বাবা যদি রিকশায় চড়ে বাসায় আসতেন তাহলে সেই রিকশা ওয়ালাকে না খাইয়ে যেতে দিতেন না। তাকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে মাকে ডাকতেন ‘রত্নার মা মেহমান এসেছে খেতে দাও’। [শাবানার ডাক নাম রত্না]। শাবানার হাতের রান্না খেয়ে সবাই প্রশংসা আর পরম তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আবার ড্রইংরুমে গিয়ে বসলেন। শাবানা আর সাদিক বললেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সিনেমা হল কমে গেছে। ছবির বাজার ছোট হয়ে গেছে। তাই ছবির বাজেট কমানো দরকার। না হলে প্রযোজক লোকসানের আশঙ্কায় ছবি নির্মাণে উৎসাহী হবেন না। শিল্পী, কলাকুশলী, নির্মাতা, সবাই যদি পারিশ্রমিক কমিয়ে নেয় তাহলে ছবির বাজেটও কমে আসে। শাবানা আর সাদিক চোখে মুখে হতাশার ছাপ এঁকে বলেন, দেশে গল্প আর গল্পের উপকরণের অভাব নেই। তারপরেও কেন আগের মতো দর্শক পছন্দের ছবি নির্মাণ হচ্ছে না? চলচ্চিত্র ছাড়িয়ে একসময় গল্প মোড় নেয় অন্যদিকে। শাবানা আর সাদিক বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সত্যিই একজন মহান মানুষ। তার উদারতার তুলনা নেই। অসুস্থ চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমানের চিকিৎসা সহযোগিতার জন্য তার কাছে গেলে তিনি যে আতিথেয়তা আর সহযোগিতা করেছেন তাতে আমরা মুগ্ধ। ওয়াহিদ সাদিক বলেন, ছবি নির্মাণ তো অনেক করলাম, এবার ভাবছি রাজনীতিতে যোগ দেব। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যশোরের কেশবপুর থেকে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার চিন্তা করছি। গল্পে গল্পে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখে রাত। এবার বিদায়ের পালা। লিফটে উঠলাম আমরা...শাবানা-সাদিকের  চোখে মুখে তখনো গল্পের রেশ লেগে আছে...হাত নেড়ে হাসি মুখে বিদায় জানালেন। অসমাপ্ত গল্পের ইতি টানতে আরেক সুন্দর সময়ের অপেক্ষায় ফিরে এলাম আমরা।

সর্বশেষ খবর