শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

এখনো সেরা মুঘল-ই-আজম

আলাউদ্দীন মাজিদ

এখনো সেরা মুঘল-ই-আজম

মুঘল সম্রাট আকবর ছিলেন নিঃসন্তান। এ নিয়ে তার মনে হতাশার অন্ত ছিল না। পীরের দরগায় প্রার্থনার ফলে জন্ম হয় শাহজাদা সেলিমের। ছেলের জন্মের সংবাদে খুশি হয়ে সম্রাট এক দাসীকে নিজের হাতের আংটি খুলে প্রতিজ্ঞা করেন, দাসী যা চায় তিনি তা-ই দেবেন। শাহজাদা সেলিম বেড়ে উঠতে থাকেন আত্ম-অহঙ্কার আর অগোছালোভাবে। পিতা বাধ্য হয়ে ছেলেকে নিয়মনীতি আর শৃঙ্খলা শেখানোর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন যুদ্ধক্ষেত্রে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর সেলিম এক নির্ভীকযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসে মহলে এবং প্রেমে পড়ে মহলের এক নর্তকী নাদিরার (আনারকলি)। এ ঘটনা জানার পর সম্রাট আকবর এ সম্পর্ক মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান এবং আনারকলিকে বন্দী করেন। শাহজাদা সেলিম আনারকলিকে মুক্ত করার জন্য পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং বন্দী হন। সম্রাট আকবরের আদালত সেলিমের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। তবে সেলিমের মুক্তির শর্ত হিসেবে আনারকলিকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলে। আনারকলি আকবরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে এবং সেলিমের মুক্তিলাভ ঘটে। সেলিমের প্রিয়তমা স্ত্রী হিসেবে আনারকলি কিছু সময় তার সঙ্গে কাটানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করলে আকবর তা মঞ্জুর করেন। সেলিমের সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্পর্ক স্থাপনের আগেই সম্রাটের নির্দেশে সেলিমকে চেতনানাশক সুগন্ধি দিয়ে অচেতন করা হয় এবং আনারকলিকে জীবন্ত কবর দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। শেষ দৃশ্যে সেলিমের জন্মের সংবাদ দেওয়ার সময় আনারকলির মাকে দেওয়া ওয়াদার কল্যাণে আনারকলির জীবন রক্ষা পায়। তবে শর্ত হিসেবে আনারকলিকে নিয়ে তার মা মুঘল সাম্রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়। আনারকলি মুক্ত হয় কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে তাকে মৃত হিসেবে প্রচার করা হয়।

মুঘল-ই-আজম বলিউডে ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক রোমান্টিক ভারতীয় হিন্দি ছবি। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন কে আসিফ এবং প্রযোজনা করেন সফররাজ পাল্লোনঝি। ‘মুঘল-ই আজম’ চলচ্চিত্রের গল্প আবর্তিত হয়েছে মূলত তিনটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে। এই তিন চরিত্র হলো—সম্রাট আকবর, শাহজাদা সেলিম এবং রাজনর্তকী আনারকলি। তিনটি চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন যথাক্রমে পৃথ্বীরাজ কাপুর, দিলীপ কুমার ও মধুবালা। এই তিন চরিত্রে এসব শিল্পীর অভিনয় নিয়েও রয়েছে মজার সব কাহিনী।

 

পৃথ্বিরাজ কাপুর [সম্রাট আকবর]

সম্রাট আকবরের চরিত্র নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্য পৃথ্বীরাজ কাপুর সম্পূর্ণভাবে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ও পরিচালকের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। চলচ্চিত্রে নিজের ভারী কস্টিউমের জন্য কাপুর নানাবিদ সমস্যার মুখে পড়েছিলেন। খালি পায়ে মরুভূমিতে হাঁটার একটি দৃশ্য ধারণের সময় তার পায়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল। চলচ্চিত্রের দৃশ্য ধারণের সময় উপস্থিত ছিলেন আলোকচিত্রী ল্যান্স ডেন। তিনি বলেন, কাপুরকে কিছু কিছু দৃশ্যে নিজের সংলাপ মনে রাখতে বেগ পেতে হয়েছে। একটি দৃশ্যের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ওই দৃশ্য ঠিকঠাকভাবে ধারণ করার জন্য কাপুরকে উনিশ বার টেক দিতে হয়েছিল। পরিচালক আসিফ জানান, চিত্র গ্রহণের সময় কাপুর পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করতেন যাতে নিজের ওজন হ্রাস পায়। সম্রাট আকবরের চরিত্রে যথাযথভাবে নিজেকে উপস্থাপনের জন্যই তিনি খাবার কম গ্রহণ করতেন। পৃথ্বীরাজ কাপুরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ছবিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে সম্রাট আকবর চরিত্রটি।

 

দিলীপ কুমার [শাহজাদা সেলিম]

নির্মাতা আসিফ প্রথমে দিলীপ কুমারকে শাহজাদা সেলিমের চরিত্রের জন্য নির্বাচন করেননি। দিলীপ কুমার নিজেও এ ধরনের চলচ্চিত্র ও চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। প্রযোজকের প্রচণ্ড আগ্রহে দিলীপ কুমার শেষ পর্যন্ত চরিত্রটি রূপায়ণে সম্মত হন। দিলীপ কুমার বলেছিলেন, ‘নির্মাতা আসিফ নিশ্চিত ছিলেন আমি সেলিম চরিত্রটি নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ ধারণ করতে পারব।’ এই চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় রাজস্থানের গরম আবহাওয়া আর শরীরে পরা ধাতব আচ্ছাদন দিলীপ কুমারকে বেশ ভুগিয়েছিল। তা ছাড়া দিলীপ কুমারের মাথায় যে চুল ব্যবহার করা হয়েছিল তা আনা হয় লন্ডন থেকে।

কিন্তু ভারতের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায় চুলটি নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। শেষ পর্যন্ত ভারতে চুলটি তৈরি করে অভিনয় করতে হয় দিলীপ কুমারকে। এই চরিত্রে দক্ষ অভিনয় প্রতিভা দেখিয়ে এই শক্তিমান অভিনেতা দর্শকের চোখে প্রকৃত শাহজাদা সেলিম হয়ে ওঠেন।

 

মধুবালা [আনারকলি]

আনারকলি চরিত্রটির জন্য নির্মাতা প্রথমে সুরাইয়াকে পছন্দ করেন। সুরাইয়া রাজি না হওয়ায় এই উল্লেখযোগ্য চরিত্রে মধুবালা কাজ করেন। তখন এই অভিনেত্রী হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তার হৃদযন্ত্রে ছিদ্র ছিল।

ছবিটি করার সময় তার হৃদযন্ত্রের সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে। যে কারণে শুটিংয়ের সেটে প্রায়ই মূর্ছা যেতেন তিনি। কারাবন্দী অবস্থার দৃশ্যধারণের সময় ত্বকে ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। মুমূর্ষু অবস্থায়ও চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি। মধুবালার এমন চ্যালেঞ্জের কারণেই ছবিতে আনারকলি চরিত্রটি উন্নত মাত্রা লাভ করে।

 

 

 

যেভাবে নির্মিত হয়

১৯৪০ সালের শুরুতে আনারকলির গল্প প্রযোজক সিরাজ আলী হাকীম এবং তরুণ নির্মাতা কে আসিফকে মুঘল-ই-আজম শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুপ্রাণিত করে। তারা চার উর্দু লেখক আমান (জিনাত আমানের পিতা, যিনি আমানুল্লাহ খান হিসেবে পরিচিত), ওয়াজাহাত মির্জা, কামাল আমরোহি এবং এহসান রিজভীকে চলচ্চিত্রের সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনার জন্য নিযুক্ত করেন। চন্দ্র মোহন, ডি. কে. সপ্রু এবং নার্গিসকে যথাক্রমে আকবর, সেলিম ও আনারকলি চরিত্রের জন্য কাস্ট করেছিলেন নির্মাতা আসিফ। ১৯৪৬ সালে বোম্বে টকিজ স্টুডিওতে এই চলচ্চিত্রের শুটিং শুরু হয়েছিল। এ ছবির কাজ বিভিন্ন সময় নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ভারত বিভাগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য এর শুটিংয়ের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দেশ বিভাগের কিছুদিন পর, সিরাজ আলী পাকিস্তান চলে যান, আসিফের তখন কোনো লগ্নিকারক ছিল না। অন্যদিকে অভিনেতা চন্দ্র মোহন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১৯৪৯ সালে। শেষ পর্যন্ত শিল্পপতি সফররাজ পাল্লোনঝি এই চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন। এরপর নতুন শিল্পীদের নিয়ে পুনরায় কাজ শুরু হয়।

 

যেভাবে সংগীতায়োজন হয়

চলচ্চিত্রের সংগীতায়োজন করেন বিখ্যাত সংগীত পরিচালক নওশাদ। গানগুলো লিখেছেন শাকিল বাদ্যয়ানি। নির্মাতা আসিফ টাকার ব্রিফকেস নওশাদের হাতে দিয়ে বলেছিলেন মুঘল-ই-আজমের জন্য স্মরণীয় সংগীত চান তিনি। টাকার বিনিময়ে কাজের মান ভালো করার প্রস্তাব পছন্দ হয়নি নওশাদের। তিনি স্ত্রীকে অবাক করে টাকা জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে স্ত্রীর মধ্যস্থতায় দুজনের মধ্যে আপস হয় এবং আসিফ ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এভাবেই নওশাদ এই চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন।

 

নির্মাণের অনুপ্রেরণা ও সফলতা

পরিচালক আসিফের মুঘল-ই-আজম নির্মাণের অনুপ্রেরণা পান ১৯৪৪ সালে পঠিত একটি নাটক থেকে। যা সম্রাট আকবরের সময়ে অর্থাৎ ১৫৫৬-১৬০৫ সালে লিখিত হয়েছিল। আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে ছবিটি নির্মাণে বিলম্ব ঘটে। 

মুঘল-এ-আজম সে সময় ভারতীয় চলচ্চিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিসরে মুক্তি পায়। টিকিটের জন্য সারা দিন লম্বা লাইনে দর্শক দাঁড়িয়েছিল। ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট মুক্তির পর এই চলচ্চিত্র বক্স অফিসের অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে বলিউডের সর্বকালের সর্বোচ্চ আয় করা চলচ্চিত্রের তালিকায় স্থান করে নেয়। যা ১৫ বছর অক্ষুণ্ন ছিল। অসংখ্য পুরস্কারের পাশাপাশি মুঘল-এ-আজম একটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, তিনটি ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার লাভ করে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো প্রথম কোনো ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে কালার ডিজিটাইলেজেশন করে ২০০৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে পুনরায় মুক্তি দেওয়া হয় এবং আবারও ব্যবসায়িক সফলতা পায় ছবিটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর