রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বড় পর্দায় সফল জুটির দেখা নেই

আলাউদ্দীন মাজিদ

বড় পর্দায় সফল জুটির দেখা নেই

হারিয়ে গেছে ঢাকাই চলচ্চিত্রে জুটি প্রথা। দেশীয় চলচ্চিত্রের গোড়াপত্তন থেকেই জনপ্রিয় জুটির ছবি দেখতে মুখিয়ে থাকত দর্শক। জুটির নামেই সফল হতো ছবি। কলকাতার উত্তম-সুচিত্রা কিংবা দিলীপ কুমার-মধুবালার মতো ঢাকাই ছবিতেও গড়ে উঠেছিল অনেক সফল জুটি। ঢালিউডে সর্বশেষ শাকিব-অপু জুটির পর তেমনভাবে আর দর্শকপ্রিয় জুটি পাওয়া যাচ্ছে না। চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, এখন ভালো গল্পের ছবির অভাব। একই সঙ্গে দক্ষ অভিনয়শিল্পীরও আকাল চলছে। মানসম্মত নির্মাতাও নেই। এই অবস্থায় নতুন জুটি গড়ে ওঠার মতো অবস্থা কোথায়।

ঢাকাই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় জুটি হিসেবে একবাক্যে বলা যায়, ‘রাজ্জাক-কবরী’ জুটির কথা। চলচ্চিত্রকার ও দর্শকরা বলেন, নায়করাজ রাজ্জাক ও মিষ্টি মেয়ে কবরীর পর্দা রসায়ন ছিল অনবদ্য। অবাক করার মতো সাবলীল অভিনয়ের কারণে দর্শক তাদের ছবির গভীরে প্রবেশ করত। রাজ্জাক ও কবরীকে জুটি করে সুভাষ দত্ত ১৯৬৮ সালে প্রথম নির্মাণ করেন ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রটি। ১৯৬৯ সালে কাজী জহিরের ‘ময়নামতি’ ও মিতার ‘নীল আকাশের নিচে’, ১৯৭০ সালে নজরুল ইসলামের ‘দর্পচূর্ণ’, মিতার ‘দীপ নেভে নাই’, কামাল আহমেদের ‘অধিকার’ চলচ্চিত্রে রাজ্জাক-কবরী জুটির প্রেমের অনবদ্য উপস্থাপন দর্শকের মনে অন্যরকম জোয়ার আনে। নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, ‘কবরীর সঙ্গে আমাকে একের পর এক জুটি করে দর্শকদের হলমুখী করে রেখেছিলেন নির্মাতারা। আমি প্রত্যেকের কাছেই ঋণী।’ কবরী বলেন, ‘একটা সময় ছিল আমি এবং রাজ্জাক একসঙ্গে একের পর এক চলচ্চিত্রে কাজ করতে করতে দর্শকের কাছে সেরা জুটি হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলাম। হল মালিকদের কাছে রাজ্জাক-কবরীর সিনেমা গেলে চোখ বন্ধ করে সে সিনেমা প্রদর্শন করতেন। হল মালিকরা জানতেন, আমাদের জুটি মানেই ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র।

চলচ্চিত্রকারদের কথায়, দেশীয় চলচ্চিত্রে রোমান্টিক জুটি প্রথার সূচনা করেন আনিস (খান আতাউর রহমান) ও সুমিতা দেবী। সুমিতাকে বলা হতো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ফার্স্টলেডি। এ জুটির সফল একটি ছবি হলো-‘কাঁচের দেয়াল’।

এরপর রহমান-শবনম জুটি বাংলা ও উর্দু— দুই ধরনের ছবিতেই ঝড় তুলেছিলেন। ১৯৬১ সাল। এই বছর প্রথম জুটি হয়ে অভিনয় করেন রহমান-শবনম ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে। এটি নির্মাণ করেন মুস্তাফিজ। চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর রহমান-শবনম জুটিকে দর্শক গ্রহণ করে নেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেরা জুটি হিসেবে প্রথম স্থান করে নেন রহমান-শবনম। শুরু হলো এ দেশের চলচ্চিত্রে জুটি প্রথা। সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নায়িকা শবনম বলেন, ‘রহমান ভাইয়ের সঙ্গে আমি যে খুব বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি তা কিন্তু নয়। তবে যে চার-পাঁচটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি, সবগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে।’ এই জুটির হারানো দিন, চান্দা, তালাশ, দর্শন ছবিগুলো এখনো দর্শক হৃদয়ে গেঁথে আছে।

লোকগাথাভিত্তিক ছবিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন আজিম-সুজাতা জুটি। গ্রামীণ কাহিনীভিত্তিক ছবিতে ফারুক-কবরী জুটি পেয়েছে অন্য মাত্রার জনপ্রিয়তা। এর একমাত্র উদাহরণ ‘সুজন সখী’ ছবিটি।

পারিবারিক আটপৌঢ়ে গল্প নিয়ে নির্মিত ছবিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে আলমগীর-শাবানা জুটি। দেশীয় চলচ্চিত্রের জুটি প্রথার ইতিহাসে ‘আলমগীর-শাবানা’ জুটি হয়ে সর্বাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাদের অভিনীত ছবি ১২৬টি, যার বেশির ভাগই ব্যবসা সফল। এখনো টেলিভিশন পর্দায় দর্শক আগ্রহ নিয়ে আলমগীর-শাবানা জুটির ছবি দেখেন। আলমগীর বললেন, আমাদের জুটির ছবি যখন মুক্তি পেত, তখন যে পজিটিভ রেসপন্সটা আসত তা সত্যিই খুব ভালো লাগত।’

টিনএজ প্রেমের ছবিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল নাঈম-শাবনাজ, সালমান-মৌসুমী জুটি। ১৯৯১ সালে এহতেশাম ‘চাঁদনী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শাবনাজ-নাঈম জুটি উপহার দেন দর্শকদের। এই জুটিরও বেশকিছু ছবি দর্শক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগায়। তবে ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পর সালমান শাহ-মৌসুমী জুটি আগের অনেক জুটির জনপ্রিয়তাকে ভুলিয়ে দেয়।

১৯৯০ সাল। এহতেশাম তার নতুন চলচ্চিত্র ‘চাঁদনী’র জন্য দুই নতুন মুখ নবাব পরিবারের ছেলে নাঈম আর বিক্রমপুরের মেয়ে শাবনাজকে উপহার দেন। প্রথম ছবিতেই জুটি হিসেবে ব্যাপক সাড়া ফেলেন নাঈম-শাবনাজ।

এরপর তারা একের পর এক অভিনয় করেন ‘লাভ’, ‘চোখে চোখে’, ‘দিল’, ‘টাকার অহংকার’, ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’, ‘সোনিয়া’ ও ‘অনুতপ্ত’সহ আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে। প্রতিটি ছবিই জনপ্রিয় ও ব্যবসা সফল হয়েছিল।  ১৯৯৪ সালে ‘তুমি আমার’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সালমানের সঙ্গে জুটি বাঁধেন শাবনূর। প্রথম ছবিতেই ব্যাপক সফলতা পায় এ জুটি। যার ফলে পরিচালক-প্রযোজকরা একের পর এক ছবিতে নিতে থাকেন তাদের। সালমান অভিনীত ২৭টি ছবির মধ্যে ১৪টিতেই তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন শাবনূর।

দর্শকনন্দিত অন্যান্য রোমান্টিক জুটি হচ্ছে— ববিতা-জাফর ইকবাল, ওয়াসিম-অঞ্জু ঘোষ, ইলিয়াস কাঞ্চন-অঞ্জু ঘোষ, মান্না-চম্পা, সালমান শাহ-শাবনূর, ওমর সানী-মৌসুমী, রিয়াজ-পূর্ণিমা, রিয়াজ-শাবনূর এবং শাকিব-অপু।

২০০৬ সালে শাকিব খান আর অপু বিশ্বাসকে জুটি করে এফআই মানিক নির্মাণ করেন ‘কোটি টাকার কাবিন’। ছবিটি ব্যবসা সফল হয় ও দর্শক গ্রহণ করে এই জুটিকে। এরপর তারা একসঙ্গে ৮০টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন। ঢালিউডে শাকিব-অপু হচ্ছে সর্বশেষ সফল জুটি।

জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এখনো পর্যন্ত রাজ্জাক-কবরী, রহমান-শবনম, শাবানা-আলমগীর, সালমান-শাবনূর, রিয়াজ-শাবনূর, শাকিব-অপু জুটি ইতিহাস হয়ে আছে। এসব জুটির প্রায় সব ছবি ব্যবসায়িক দিক দিয়ে সফল ও দর্শক হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে।

সর্বশেষ খবর