বুধবার, ২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
সংগীতজ্ঞদের দৃষ্টিতে

ইউটিউবনির্ভর মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি

ইউটিউবনির্ভর মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গান শোনা বা দেখার মাধ্যমে চলে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। অনেকেই একে বলছেন ‘ডিজিটাল গানের যুগ’ বর্তমানে চলছে অনলাইনে গানের প্রকাশনা। তার মধ্যে মিউজিক ভিডিওর জন্য জনপ্রিয় হয়েছে ইউটিউব। এ বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকারের সঙ্গে। তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন— আলী আফতাব

 

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

ইউটিউব বা যে মাধ্যমই হোক না কেন— দেশ, সংস্কৃতি, ভাষা, মাটির গানকে বেশি উপস্থাপন করতে হবে। সঠিক চর্চার মাধ্যমে গানকে জনপ্রিয়তার পর্যায়ে আনা যায়। এখন থেকে চল্লিশ বছর আগেও অনেক গান তৈরি হয়েছে, যেগুলো এখনো সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য। আমরা মর্ডান হই কিন্তু গানের মধ্যে আমাদের নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ ফুটিয়ে তুলতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, আমরা কোন দেশের অধিবাসী। আমাদের নিজস্বতা কী। আমরা এই দেশ, ভাষা স্বাধীনতা যুদ্ধ করে অর্জন করেছি। বাংলাদেশকে যেন আমরা গানের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তুলতে পারি সেই চেষ্টা করতে হবে। তা ইউটিউবে হতে পারে বা অন্য যে কোনো মাধ্যমেই হতে পারে। আদর্শগতভাবে কোনো কিছু করলে ইউটিউব ভালো মাধ্যম হতে পারে।

 

ইন্দ্রমোহন রাজবংশী

এখন তো ইন্ডাস্ট্রি নেই বললেই চলে। সিডি নেই, অডিওর বাজার এখন আগের সেই অবস্থায় নেই। উপায় তো নেই। সবাই সুখাদ্য না পেলে তো অখাদ্য খাবেই। ইউটিউব কিন্তু অখাদ্য নয়। এতে সব কিছুই পাওয়া যায়। ইউটিউবে সব কিছু সঠিক নয়। গানের গীতিকার, গানের ধরন ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় ভুলে ভরা। গায়কের সম্মতি ছাড়া আপলোড দেওয়া হচ্ছে। কোনটা লালনগীতি আর কোনটা মৌলিক সংগীত তার কোনো সঠিক বিবরণ যেন পাওয়াই যায় না। অন্যের গান আরেকজনের নামে, অন্যের রচনা করা গান আরেকজনের নামে হরহামেশাই ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে। কিছু গান সঠিক আছে আবার অনেক গানের ইনফরমেশন সঠিক নেই। তবে এটা এক দিক দিয়ে ভালো যে, আমাদের গানসহ বিশ্বের অনেক গানের বিশাল সমাহার ইউটিউব। আসলে গুরুমুখী বিদ্যা হলো গান; এখন কিন্তু তা নেই। এখন গুরু বলতে ইউটিউব। আমাদের যেটা খাওয়াচ্ছে, আমরা তাই খাচ্ছি। উপায় তো আর নেই, ভালো হোক, মন্দ হোক—তবুও তো একটা কিছু পাওয়া যাচ্ছে।

 

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

একটি গানের মূল বিষয় হচ্ছে কথা, সুর ও সংগীত। এই তিনটি বিষয় যদি সঠিক হয় গান জনপ্রিয় হবেই। অনেকে গানের মূল বিষয়টা ঠিক না রেখে অনেক টাকা খরচ করে মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করে। আমি মনে করি এতে কোনো সুফল বয়ে আনে না। গানটা হচ্ছে মনের বিষয়। মন থেকে যদি কোনো গান ভালো না লাগে, আমি কী করে গানটি শুনব। আমাদের আধুনিকতার সঙ্গে চলতে হবে, তার মানে এই নয় যে, যা খুশি তা করতে হবে। ইউটিউব এখন একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে যা খুশি তা প্রকাশ না করাই ভালো।

 

ফাহমিদা নবী

প্রতিটি মানুষের ভিতরে একটি সুপ্ত বাসনা আছে। তার মধ্যে অনেকগুলো ভালো আর কিছু মন্দ। আমরা এখন যা মন চায় তাই করি। এই আধুনিকতার যুগে গান প্রচারের একটি শক্ত মাধ্যম হচ্ছে ইউটিউব। এখানে অনেকে যা মন চাচ্ছে তাই দিয়ে দিচ্ছে। এটা ঠিক নয়। একটা সময় আমরা রেকর্ডে গান শোনতাম। তারপর এলো ক্যাসেট, এমনি করে সিডি, ডিভিডির পালা শেষ হয়ে এখন গান চলে আসছে অনলাইনে। সময়ের সঙ্গে চলতে হলে আমাদের আধুনিক হতে হবে। তার মানে এই নয় যে, গান নিয়ে যা খুশি তাই করব। একটি ভালো গানের জনপ্রিয়তার জন্য কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না।

 

কুমার বিশ্বজিৎ

আমাদের আধুনিকতার সঙ্গে চলতে হবে। আর বর্তমানে মিউজিক ভিডিও প্রচারণায় ইউটিউব একটি শক্ত মাধ্যম। আমি বলতে চাই আমাদের মাধ্যমটা ঠিক আছে, কিন্তু মূল বিষয়টি ঠিক নেই। আর মূল বিষয়টি হচ্ছে গান। ভালো গান না করে অনেক টাকা খরচ করে মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করে কী হবে। এখন আমাদের বুঝতে হবে কারা অনলাইনে গান শুনে। এই ইউটিউব ব্যবহারকারী কারা। আমরা জানি একটি নির্দিষ্ট বয়সের দর্শক-শ্রোতারা ইউটিউব ব্যবহার করে। এই নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শক-শ্রোতা দিয়ে কেউ কোনো দিন জনপ্রিয় হতে পারে না।

এ ছাড়া অনেকে এখন টাকা খরচ করে বুস্ট করে মিউজিক ভিডিওর ক্লিক বাড়ায়। আমি মনে করি এটি শুধু মনের আত্মতৃপ্তি। আমার নব্বই শতাংশ গানের এখনো কোনো মিউজিক ভিডিও হয়নি। তাই বলে আমার গান কি জনপ্রিয় নয়।

 

ইমন সাহা

একটা সময় কিছু সিনেমা নির্মাতা ও প্রডিউসার শুধু সিনেমা নির্মাণের জন্য সিনেমা করত। তাদের সিনেমা শুধু সংখ্যায় বাড়ত। তাদের সিনেমা যখন মুক্তি পেত তারা দর্শক পেত না। তখন তারা নিজের টাকা দিয়ে টিকিট কিনে হলের বাইরে ঝুলিয়ে দিত হাউস ফুলের ব্যানার। এটি ছিল তাদের মনের সান্ত্বনা। এ বিষয়টি বলার একটি কারণ আছে। কিছুদিন আগে আমেরিকার একটি রেডিওতে আমার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য ফোন করে। আমার জনপ্রিয় গানগুলো সম্পর্কে জানতে চায়। তখন আমি দেখলাম, আমার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘খায়রুন সুন্দরী’র ইউটিউবে লাইক আছে মাত্র আট লাখ। কিন্তু সম্প্রতি কিছু নতুন মিউজিক ভিডিও লাইক দেখলাম বিশ লাখেরও বেশি। অথচ গানটি আমার আশপাশের কেউই শুনেনি। তাহলে কী করে এত লাইক হলো। এ গল্প বলার কারণ হচ্ছে, বুস্ট করে জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় না। এত টাকা খরচ করে বুস্ট না করে, ওই টাকা দিয়ে ভালো কিছু গান করা দরকার।

সর্বশেষ খবর