শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

দর্শক সংকটে মঞ্চনাটক

মোস্তফা মতিহার

দর্শক সংকটে মঞ্চনাটক

চলচ্চিত্রের মতো দুর্দিন এখন মঞ্চনাটকেও। অভিনয়ের পাঠশালা বলে খ্যাত মঞ্চনাটক বিচ্যুত হয়ে পড়েছে ঐতিহ্য থেকে, ভুগছে দর্শক সংকটে। বিশ্বনাটকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মঞ্চনাটক সর্বশ্রেষ্ঠ হলেও ধীরে ধীরে তা বিলীন হতে চলছে দর্শকশূন্যতায়। মানের দিক থেকে এখনো এদেশের নাটকের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া হলেও গ্রহণের কাল যেন ছাড়ছেই না মঞ্চনাটককে। অমানিশার তমসা যেন চারদিকে ঘিরে ধরেছে বাঙালির অহংকার করার এই মাধ্যমটিকে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মঞ্চাঙ্গনের নাট্যকর্মীদের অবদান নিঃসন্দেহে ছিল প্রশংসনীয়। লোকনাট্যদল (সিদ্ধেশ্বরী)-এর ‘কঞ্জুস’ আর নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের ‘রক্তকরবী’ ছাড়া এদেশের কোনো নাটকেই এখন আর তেমন দর্শক সমাগম ঘটে না। বিদেশি নাট্যকার মলিয়েরের হাস্য-রসাত্মক নাটক বলে ‘কঞ্জুস’-এর প্রতি দর্শকদের আগ্রহে ভাটা পড়েনি। আর বিশ্বকবির ‘রক্তকরবী’ নাটকটি দেখতে দর্শকরা আসছেন শুধু টিভি তারকা অপি করিমের কারণেই। কারণ নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করছেন টেলিভিশনের জনপ্রিয় এই তারকা অভিনেত্রী। জমকালো ও বর্ণাঢ্য উৎসবের মধ্য দিয়ে নাটকের দলগুলো তাদের প্রযোজনাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করার পরও দর্শকদের উপস্থিতি আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গর্ব করার এই অঙ্গনটি বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না— এমন ধারণা নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে ১৯৭২ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের ‘বাকী ইতিহাস’ নাটকটির মধ্য দিয়ে দর্শনীর বিনিময়ে এদেশে প্রথম নাটকের মঞ্চায়ন শুরু হয়। বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ওই সময় এই নাটকটি মঞ্চায়ন হয়। দর্শক সমাগম বৃদ্ধি ও নাটকের দলের বৃদ্ধির কারণে পরবর্তীতে

গাইড হাউস মিলনায়তনেও শুরু হয় নাটকের মঞ্চায়ন। ‘বাকী ইতিহাস’ থেকে শুরু করে অর্থাৎ ৭২ থেকে নব্বই দশকের শেষদিক পর্যন্ত স্বর্ণালি দিন ছিল মঞ্চাঙ্গনে। ২০১১ সালে নাটকের ইতিহাস সমৃদ্ধ বেইলি রোডের মহিলা সমিতির মিলনায়তনটি বন্ধ হওয়ার পর নাট্যাঙ্গনে দেখা দেয় অশনি-সংকেত। ওই সময়ে পাঁচদিনব্যাপী ‘ভাঙ্গা-গড়া’ উৎসবের মধ্য দিয়ে নাট্যাঙ্গনের মানুষরা বুকভরা কষ্ট চেপে অনেক স্মৃতিবিজড়িত ও ইতিহাস সমৃদ্ধ এই মঞ্চটিকে বিদায় জানায়। মহিলা সমিতির মঞ্চটি ভাঙার পর নাট্যাঙ্গনের মানুষের মাঝে নেমে আসে রাজ্যের হতাশা। নতুন মঞ্চ শিল্পকলা একাডেমিতে দর্শক নাটক দেখতে আসবেন কিনা, এলেও বেইলি রোডের মহিলা সমিতি কিংবা গাইড হাউসের মতো দর্শক সমাগম এতটা ঘটবে কিনা এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছিল নাট্যাঙ্গনের মানুষের মাঝে।

নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, যানজটের কারণেই নাটকের দর্শক কমে গেছে। এছাড়া নাটকের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। তার মতে, নাটকের দল ও নাটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও নাটকের মান এখন আর আগের জায়গায় নেই। যার কারণে দর্শক এখন আর মঞ্চনাটকের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ঝুনা চৌধুরী বলেন, ট্রাফিক জ্যামের কারণে কর্মদিবসগুলোতে দর্শক কম থাকে। তবে শুক্রবার, শনিবার ও বিভিন্ন ছুটির দিনগুলোতে দর্শকের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন নানা ব্যস্ততায় দর্শক আগের মতো পরিবার-পরিজন নিয়ে নাটক দেখতে আসছেন না। আর মানসম্মত না হওয়ার কারণে অনেক নাটকে দর্শক সংকট থাকে বলেও তিনি মনে করেন।

নাট্যব্যক্তিত্ব লাকী ইনাম বলেন, নাটক দেখার দর্শক কমে গেছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্পকলায় এসে নাটক দেখা সম্ভব নয়। মিরপুর, গুলশান, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় মঞ্চনাটকের জন্য মঞ্চ তৈরি করতে হবে। তবেই দর্শক তৈরি হবে। এক্ষেত্রে আমাদের তরুণ নির্মাতাদের দর্শক ফিরিয়ে আনতে বা তৈরি করতে ভালো ভালো নাটক মঞ্চে আনতে হবে। তবে এ সময় যারা কাজ করছেন, তারা সম্পূর্ণভাবে নিজেকে তৈরি করেই এই কাজে আসছেন। আমরাও অনেক ভালো ভালো কিছু প্রযোজনা পাচ্ছি মঞ্চে। এভাবেই আসলে দর্শক তৈরি হবে। এ সংকট স্থায়ী নয় ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর