শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিনেমার ফেরিওয়ালার গল্প

আলী আফতাব

সিনেমার ফেরিওয়ালার গল্প

তারেক মাসুদ, বাংলা সিনেমার একজন ফেরিওয়ালা। নিজের সৃষ্টি কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন বহুবার। চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়কে এবং বাংলাদেশকে তুলে ধরার দায়িত্ব নিয়েছিলেন যেন তিনি। এই চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায়ই আকস্মিকভাবে মহাপ্রয়াণ ঘটে বাংলা চলচ্চিত্রের এই কৃতি সন্তানের। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন নির্মাতা তারেক মাসুদ। মৃত্যুর ষষ্ঠ বার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।

তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন থেকে। তিনি চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তিনি দেশে-বিদেশে অনেকগুলো কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৮২ সালে তিনি শিল্পী এস এম সুলতানের ওপর ডকুমেন্টারি আদম সুরত নির্মাণ শুরু করেন। আদম সুরত মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে। এর আগে অবশ্য ১৯৮৭ সালে সোনার বেড়ী নামে বাংলাদেশের নির্যাতিত নারীদের ওপর তিনি ২৫ মিনিট স্থায়িত্বের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৯২ সালে স্ত্রী ক্যাথেরিন মাসুদের সঙ্গে যৌথভাবে তারেক একটি অ্যানিমেশন শট ফিল্ম নির্মাণ করেন। যার দৈর্ঘ্য মাত্র তিন মিনিট। তারেক মাসুদ মুক্তির গান চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের কাছে ব্যাপকমাত্রায় পরিচিতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দুর্লভ কিছু ফুটেজ থেকে মুক্তির গান চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ। ২০০২ সালে মাটির ময়না চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিতে ভূমিকা পালন করেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস এর বিদেশি মুভির ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতা করে এই চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়া তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র বিষয়ে গভীর জ্ঞানপূর্ণ লেখালেখি করেছেন। তার লেখা বিভিন্ন আর্টিকেল নিয়ে একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। মাটির ময়না চলচ্চিত্রের প্রিক্যুয়েল হিসেবে তারেক মাসুদ ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ চলচ্চিত্রেরই লোকেশন দেখে ফেরার সময় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াজুড়িতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন। এতে তিনি ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশফাক মুনীর মিশুকসহ পাঁচজন নিহত হন। দুর্ঘটনায় নিহত বাকি তিনজন হলেন, মাইক্রোবাস চালক মুস্তাফিজ, তারেক মাসুদের প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াসিম ও কর্মী জামাল। একই গাড়িতে ক্যাথেরিন মাসুদ থাকলেও সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। তারেক মাসুদের বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ এবং মায়ের নাম নুরুন নাহার মাসুদ। ভাঙ্গা ঈদগা মাদ্রাসায় তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে তিনি মৌলানা পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে এবং যুদ্ধের পর তিনি সাধারণ শিক্ষায় প্রবেশ করেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তিনি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ছয় মাস পড়াশোনার পর বদলি হয়ে নটর.ডেম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথেরিন মাসুদ একজন মার্কিন নাগরিক। এই দম্পত্তির একটি পুত্রসন্তান রয়েছে, নাম ‘বিংহাম পুত্রা মাসুদ নিশাদ’। বাংলা চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদের যে অবদান, তা আজীবন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরিত হবে।

 

স্মরণে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের জোকায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বরেণ্য চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, চিত্রগ্রাহক-সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ আরও তিন চলচ্চিত্রকর্মী। যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতিকে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়।

সেই সূত্রে ১৩ আগস্ট বিকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর স্মরণে স্মৃতিতর্পণ এবং ‘তারেক মাসুদ স্মারক বক্তৃতা ২০১৭’। এটি আয়োজন করছে ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি এবং তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। এই দিন বিকাল ৫টায় প্রদর্শিত হবে তারেক মাসুদ নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘আদমসুরত’। সন্ধ্যা ৬টায় প্রদর্শিত হবে তারেক মাসুদের জীবনের ওপর প্রসূন রহমান নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘ফেরা’। সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ নিহত চলচ্চিত্র কর্মীদের স্মরণে মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বালন। সন্ধ্যা ৭টায় প্রথমে প্রসূন রহমান নির্মিত ‘আগস্টের আরিচা রোড’ শিরোনামে একটি বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদর্শিত হবে। তারপর স্মৃতিতর্পণ এবং স্মারক বক্তৃতা আয়োজন। এই বিশেষ আয়োজনে অংশগ্রহণ করবেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ এবং চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম।

স্মৃতিতর্পণ ও স্মারক বক্তৃতা আয়োজনে প্রারম্ভিক আলোচনা করবেন এবং সঞ্চালনা করবেন ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি বেলায়াত হোসেন মামুন। আয়োজনের সভাপতিত্ব করবেন ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ (এফএফএসবি) সভাপতি স্থপতি লাইলুন নাহার স্বেমি।

 

 

 

একনজরে তারেক মাসুদের সৃষ্টিকর্ম

♦  আদম সুরত

♦  সে

♦  ইউনিসন

♦  মুক্তির গান

♦  ভয়েসেস অফ চিলড্রেন

♦  ইন দ্য নেইম অফ সেফিট

♦  মুক্তির কথা

♦  নারীর কথা

♦  মাটির ময়না

♦ আ কাইন্ড অফ চাইল্ড হুড

♦ অন্তর্যাত্রা

♦ রানওয়ে

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর