শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

জীবনের আয়নায় জহির রায়হান

জীবনের আয়নায় জহির  রায়হান

আজ খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের জন্মদিন। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এরপর পিতার কর্মসূত্রে ওপার বাংলায় চলে যান। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর পরিবারের সঙ্গে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান) ফিরে আসেন। এক সময় এদেশের একজন অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি। জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে নিয়ে লিখেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

সাংবাদিক থেকে চলচ্চিত্রকার

জহির রায়হান ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর সাহিত্যিক ও সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। ১৯৫০ সালে যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ১৯৫৭ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে। তিনি সালাউদ্দীনের ‘যে নদী মরুপথে’ ছবিতেও সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ ছবির নামসংগীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬১ সালে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন (উর্দু )। পরের বছর এদেশের প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ নির্মাণ করেন।

ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখা যায় ১৯৭০ সালে তার নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কলকাতায় চলে যান। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযানে অংশ নেন ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময় তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করেন।

 

জহির রায়হানের যত চলচ্চিত্র

১৯৬২ সোনার কাজল, ১৯৬৩ কাঁচের দেয়াল, ১৯৬৪ সঙ্গম [পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র], ১৯৬৫ বাহানা [পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নির্মিত প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র], ১৯৬৬ বেহুলা, ১৯৬৭ আনোয়ারা, ১৯৬৮ দুই ভাই, ১৯৬৮ কুচবরণ কন্যা, ১৯৬৮ জুলেখা, ১৯৬৮ সুয়োরাণী-দুয়োরাণী, ১৯৬৮ সংসার, ১৯৭০ জীবন থেকে নেয়া, ১৯৭০ লেট দেয়ার বি লাইট, ১৯৭১ জলতে সুরজ কে নীচে, ১৯৭১ স্টপ জেনোসাইড, ১৯৭১ বার্থ অব আ নেশন/এ স্টেট ইজ বর্ন, ১৯৭১ চিলড্রেন অব বাংলাদেশ।

 

যত সম্মাননা

কালজয়ী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জহির রায়হান অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পুরস্কার হলো-আদমজী সাহিত্য পুরস্কার-১৯৬৪ (হাজার বছর ধরে), নিগার পুরস্কার ‘কাঁচের দেয়াল’ [শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি]। বাংলা একাডেমি পুরস্কার-১৯৭১, একুশে পদক ১৯৭৭ [চলচ্চিত্র : মরণোত্তর], স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার-১৯৯২ [সাহিত্য : মরণোত্তর]।

 

দেশে ফেরা ও অন্তর্ধান

জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে আসেন এবং তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন। যিনি স্বাধীনতার ঠিক আগ মুহূর্তে পাকবাহিনীর এদেশীয় দোসর আলবদর বাহিনী কর্তৃক অপহূত হয়েছিলেন। জহির রায়হান ভাইয়ের সন্ধানে মিরপুর যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। ১৯৭২-এর ৩০ জানুয়ারির পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

 

জহির রায়হানের পরিবার

বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হানের দুই স্ত্রীর একজন সুমিতা দেবী। এই প্রয়াত অভিনেত্রীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত নাট্যনির্মাতা। আরেক স্ত্রী প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুচন্দার ছোট ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা। তিনি ‘সবুজ কোট কালো চশমা’ ও ‘প্রেম প্রীতি’ ছবিতে অভিনয় করেন।  

 

 

সব হারিয়ে স্বাধীন দেশ পেয়েছি, এই আমার সান্ত্বনা : সুচন্দা

জহির রায়হানের সহধর্মিণী প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুচন্দা। স্বাধীনতা যুদ্ধে শিশুসন্তানসহ স্বামী জহির রায়হানের সঙ্গে তিনিও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশ স্বাধীন হলো। বাঙালি জাতি স্বতন্ত্র একটি পতাকা পেল। স্বাধীন দেশে বীরের বেশে জহির রায়হানও ফিরলেন। বিজয়ের রেশ না কাটতেই সুচন্দা হারান তার  প্রিয় স্বামীকে। সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়া করে ফেরে এই খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সুচন্দাকে। স্বামী হারানোর সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বেদনাবিধুর সুচন্দা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। মিরপুরে কারফিউ জারি করে সার্চ পার্টি পাঠানো হয়। ওই দিন জহির রায়হানকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিরপুর ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল বেলায় তিনি বাসার নিচতলায় বসেছিলেন। হঠাৎ কয়েকজন লোক আসে। তাকে বলা হয় শহীদুল্লাহ কায়সারসহ নিখোঁজ অনেককে মিরপুরে পাওয়া গেছে। তিনি দ্রুত দোতলায় উঠেন। ওই সময় তাকে খুব অস্থির ও বিচলিত দেখাচ্ছিল। আগতরা তাকে এও বলেছিল, মিরপুরে অপারেশন হবে। ভারতীয় আর্মিরা যাবে সেখানে। জহির এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। নিচে কয়েকজন আর্মি অফিসার ও তার চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবীর অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ আবার ওপরে উঠে টাকা চাইলেন। বললেন টাকা নেই, গাড়ির পেট্রল কিনতে হবে। আমি টাকা দিলাম। ও চলে গেল। আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে কেবল ওর চলে যাওয়া দেখলাম। তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি সে যাওয়াই হবে জহিরের শেষ যাত্রা। সারা ঘরময় বিষাদের নীরবতা আর ভয়ার্ত অন্ধকার। মিরপুর থানায় ফোন দিলাম। রিসিভ করলেন মেজর মঈন। তাকে জহিরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি মেজর মতিউরকে ফোন ধরিয়ে দিলেন। তিনি বললেন তিনি ব্যস্ত, এখন দেওয়া যাবে না। আবার ফোন দিলাম। কে একজন জানালেন মিরপুরে গোলাগুলি হয়েছে, জহিরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আমরা ব্যস্ত, আর কিছু বলতে পারব না। নির্বাক হয়ে গেলাম। কাঁদতেও পারছিলাম না। কান পেতে থাকি, ওই বুঝি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে, এক্ষুনি ডাকবে। কিন্তু না, এভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। ক্যান্টনমেন্ট গেলাম। মেজর মঈন ও মতিউরের সঙ্গে দেখা করলাম। তারা বললেন, ওইদিন মিরপুরে অপারেশন হয়েছে। কোথায় গেছেন, কি হয়েছে তার, কিছুই জানেন না তারা। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলাম, কয়েক দিন পর মিরপুর থানায় গেলাম। ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য পুলিশের সাহায্য চাইলাম। পুলিশ দুজন অবাঙালিকে ধরে আনলো। তাদের বর্ণনায় সেদিন বিহারিদের সঙ্গে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়েছিল সেখানে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ তাদেরসহ আমাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। আশপাশের কয়েকটি কলাগাছের নিচে মাটি খোঁড়া হলো। বেরিয়ে এলো অসংখ্য মৃতদেহ। মৃতদের গায়ে কাপড় নেই। পচে বীভত্স হয়ে গেছে। চেনারও উপায় নেই। এরপর পুলিশ একটি কুয়ার কাছে নিয়ে গেল। মৃতদেহে ভর্তি ছিল কুয়াটি। আমি ভয়ে আঁেক উঠলাম। কোথাও জহির রায়হানকে খুঁজে পেলাম না। তারপর অনেক সময় পেরিয়ে গেল। নিশ্চিত হলাম জহির রায়হানকে হারিয়ে ফেলেছি। জীবনের সব হারিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ পেয়েছি।

এই প্রাপ্তিই আমার জীবনের বড় সান্ত্বনা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর