শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নকল সন্ত্রাসে ফের নাকাল ঢাকাই ছবি

আলাউদ্দীন মাজিদ

নকল সন্ত্রাসে ফের নাকাল ঢাকাই ছবি

ঢাকাই ছবি ফের নকল সন্ত্রাসে নাকাল হলো। ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘অহংকার’ ছবিটি ২০০৫ সালে ভারতের কান্নাড়ায় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অটোশঙ্কর’ ছবির কার্ট টু কার্ট নকল। গত কয়েক বছরে ঢাকাই ছবির উদ্বেগজনক চিত্র হচ্ছে সিংহ ভাগ ছবিই হলো নকল। মানে নকলে ডুবছে আমাদের চলচ্চিত্র। দর্শকের কথায়, নকলের বিষয়টি এতটাই প্রকাশ্য হয়ে গেছে যে, তা এখন দিন-দুপুরে ডাকাতি মনে হয়। এক-দেড় দশক আগের হিন্দি ছবি থেকে টুকলিফাই করা হতো। আর এখন কান্নাড়া, তামিল, তেলেগু, মারাঠি, হলিউড, কোরিয়ানসহ বিভিন্ন ছবি থেকে হুবহু নকল করা হচ্ছে। তামিল, তেলেগু, মারাঠি ছবি নকল করতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে সুইপার কলোনির। হিন্দি ছাড়া বাকি ভাষা সবার আয়ত্তে থাকে না বলে তা অনুবাদের জন্য নির্মাতারা মাদ্রাজি সুইপারদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। নকল এখন গল্প, গান, পোস্টারসহ ছবির পুরো শরীরে দুরারোগ্য ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

গত কয়েক বছরে মুক্তি পাওয়া নকল ছবির একটি চিত্র তুলে ধরা হলো— ‘দাবাং’ [তেলেগু ডন],  ‘অগ্নি’ [আমেরিকান কলোম্বিয়ানা], ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’  [আমেরিকান ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’], ‘রাজত্ব’ [ তেলেগু ‘গাজাপাক্কিরি’], ‘ডেয়ারিং লাভার’ [তামিল ‘থিরভিলাইয়াডাল আরামবাম’ ও কলকাতার ‘ইডিয়ট’], ‘মায়ের মমতা’ [স্টার জলসা চ্যানেলের সিরিয়াল ‘মা’], ‘জান’ [তেলেগু ‘মাস’], ‘ভালোবাসা এক্সপ্রেস’ [তেলেগু ‘শিবামনি’ ও  ‘মিরচি’র সংমিশ্রণ], ‘আই ডোন্ট কেয়ার’ [তেলেগু ‘রেবেল’সহ একাধিক ছবি], ‘হানিমুন’ [তেলেগু ‘রাচা’সহ একাধিক ছবি], ‘অদৃশ্য শত্রু [ হিন্দি ‘বাজিগর’ ও ‘কিডন্যাপ’], ‘অল্প অল্প প্রেমের গল্প’ [তেলেগু ‘আলা মোদালাইন্দি’], ‘লাভ স্টেশন’ [তেলেগু ‘ইশক’], ‘হিটম্যান’ [তামিল ‘ভেট্টাই’], ‘কঠিন প্রতিশোধ’ [তেলেগু ‘মিরচি’], ‘কিস্তিমাত’ [তেলেগু ‘গাব্বার সিং’], ‘জানে না এ মন’ [ হিন্দি ‘গ্যাংস্টার’], ‘স্বপ্ন যে তুই’ [হিন্দি ‘জানে তু ইয়া জানে না’], ‘প্রেম করব তোমার সাথে’ [হিন্দি ‘দিলিওয়ালে’ এবং তেলেগু ছবি ‘নায়াক’]।  পোড়ামন, প্রেম প্রেম পাগলামী, ফাঁদ নিয়েও নকলের অভিযোগ রয়েছে। ‘ভালোবাসা এক্সপ্রেস’ ছবিটি নকল করা হয়েছে তেলেগু ছবি ‘রেড দ্য কালার অব লাভ’ থেকে। এ ছবিটি হিন্দিতে ‘ডেঞ্জারাস খিলাড়ি’, মালায়াম ‘গাজাপাক্কিরি’ ও তামিল ভাষায় ‘সাহাসাস’ নামে আগেই নির্মাণ হয়েছে। ‘জান কোরবান’ নকল করা হয়েছে কলকাতার ‘আই লাভ ইউ’ থেকে। ‘রাজাবাবু’ ছবিটি তামিল ‘ধাম্মু’ এবং ‘আশিকি’ তামিল ‘ইশক’ ছবির নকল। ‘ব্ল্যাকমেইল’ হিন্দি ‘গুণ্ডে’ ছবির নকল। ‘আজব প্রেম’ তামিল ‘আরিয়া টু’ ছবির হুবহু নকল।

প্রতি বছর নকল ছবির উদ্বেগজনক চিত্র অব্যাহত থাকলেও ২০১৫ সালকে চলচ্চিত্র বোদ্ধারা নকলের শীর্ষ বছর বলে অভিহিত করেন। এ বছর মুক্তি পাওয়া ‘রোমিও বনাম জুলিয়েট’ [পাঞ্জাবি সিনেমা ‘সিং ভার্সেস কৌর’এর নকল। বিগ ব্রাদার [সাউথ কোরিয়ান  Jopok Manura], পাগলা দিওয়ানা [Bujjigadu], গুণ্ডা-দ্য টেররিস্ট [তেলুেগু Yevadu], ওয়ার্নিং [তামিল Ramanaa], বোঝে না সে বোঝে না [তামিল Deepava], অ্যাকশন জেসমিন [তেলুগু Vikramarkudu], ইউ-টার্ন [ফ্রান্সিস The godfather], ব্ল্যাকমানি [তেলুগু  Paisa], লাভার নাম্বার ওয়ান [তেলুগু Raghavendra], ব্ল্যাকমেইল [হিন্দি gunday], রাজা বাবু [তেলুগু Dammu], আশিকী [তেলুগু Ishq], ভালোবাসতে মন লাগে [তেলুগু Okkad]। নগর মাস্তান [তামিল Kaadhal], আজব প্রেম [তেলুগু Arya-2]। ২০১৬ সালও ছিল ঢাকাই ছবিতে নকলের মহোৎসব। এ বছর মুক্তি পাওয়া নকল ছবিগুলো হলো—অঙ্গার [কানাড়ার আপ্পায়া], পুড়ে যায় মন [তেলেগু গঙ্গোত্রী], হিরো ৪২০ [ তেলেগু মাস্কা], মন জানেনা মনের ঠিকানা [সনি টিভির আদালত সিরিয়াল], বাজে ছেলে [তামিল মানাম্মাধাম], শিকারি [তামিল আন্ধাবান], মাস্তানি [হিন্দি চেতনা], বসগিরি [হিন্দি মুন্নাভাই এমবিবিএস], রক্ত [হলিউডের দ্য লং কিস গুড নাইট], প্রেম কি বুঝিনি [তেলেগু ১০০% খড়াব], চোখের দেখা [হিন্দি লাফাঙ্গে পারিন্দে], অনেক দামে কেনা [হলিউডের সিটি লাইট], মেন্টাল [কানাড়ার আচ্ছান], বাদশা [তেলেগুর ডন সিনু], নিয়তি [হলিউডের দ্য নোটবুক], মুখোশ [হিন্দি আক্সার] প্রভৃতি। এসব নকল ছবির তালিকা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে, নকলের দৌরাত্ম্যে ঢালিউডের অবস্থা কতটা ভয়াবহ। বর্তমানে নকল হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। গল্প, গান, শট টু শট, কস্টিউম থেকে শুরু করে পোস্টার পর্যন্ত।

এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চলচ্চিত্রকাররা। চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, আমরা নকল কেন করব। আমাদের দেশে গল্পের অভাব কোথায়। অভাব হচ্ছে মেধা ও রুচির। মানসিকতার উন্নতি না হলে করার কিছুই নেই। আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কেন কুড়াল মারছি?

অভিনেতা ফারুক বলেন, ‘যাদের মেধা নেই, তারাই এমন গর্হিত কাজ করে। কতিপয় অসাধু লোক পরিশ্রম না করে রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিক হতে চায়। এরা নকলের আশ্রয় নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রের বারোটা বাজাচ্ছে। আমি বলি আপনারা কী দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছেন? আসলে এ অবস্থার জন্য সেন্সর বোর্ড দায়ী। নকল চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে সেন্সর বোর্ডের প্রয়োজন কী?’ এদিকে সেন্সর বোর্ডের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা নকল সম্পর্কে তথ্য দিতে বলেন। অথচ তথ্য দিলেও পরে আপিল করে নকল ছবি ছাড় পেয়ে যায়। এমন অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি হলো ‘হিটম্যান’।

দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিতে সচেতন দর্শক এবং চলচ্চিত্রকর্মীরা দ্রুত নকলমুক্ত চলচ্চিত্র নির্মাণের জোর দাবি জানিয়েছেন। আর এজন্য সেন্সর বোর্ডকে যথাযথ দায়িত্ব পালনের আহ্বান তাদের।

সর্বশেষ খবর