বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফোরাম আর পরিবারে বিভক্ত চলচ্চিত্র

ফোরাম আর পরিবারে বিভক্ত চলচ্চিত্র

দেশীয় চলচ্চিত্রে এখন বিভাজন সুস্পষ্ট। চলচ্চিত্রকারদের মতে পদ-পদবি, ঈর্ষা আর দলাদলির কারণেই এ বিভাজন। চলচ্চিত্রের উন্নয়নের কথা বলা হলেও বাস্তবে চলছে এর উল্টো চিত্র। চলচ্চিত্র শিল্পের জন্মলগ্ন থেকে এ অবস্থা কখনো দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে চলচ্চিত্র পরিবার আর চলচ্চিত্র ফোরামে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এ শিল্প। এ অবস্থাকে চলচ্চিত্র গবেষক, শিক্ষক আর সিনিয়র চলচ্চিত্রকাররা কীভাবে দেখছেন। তা-ই তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

 

আমজাদ হোসেন [চলচ্চিত্রকার ও গীতিকার]

দুঃখ হয় চলচ্চিত্র শিল্পের দূরবস্থা দেখে। এমনিতেই দেশীয় চলচ্চিত্রের অবস্থা ভালো নয়। তার ওপরে এই বিভাজন কতটা মঙ্গল বয়ে আনবে তা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখতে বলব। একসময় পুরো চলচ্চিত্র শিল্প ছিল একটা পরিবার। সবাই মিলে মিশে ভালো কাজ দর্শক আর দেশকে ভালো ছবি উপহার দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এখন এমনিতেই নানা সমস্যার কারণে ছবি চলছে না। দর্শক সিনেমা হল বিমুখ। প্রযোজক নির্মাণে আসছেন না। এর ওপর যদি দলাদলি তৈরি হয় তা হলে প্রযোজকরা আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কায় একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেবে। এমন নেতিবাচক পরিস্থিতির উদ্ভব না ঘটিয়ে সবাই বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করে ঐক্যবদ্ধভাবে যদি কাজ করতে পারি তাহলে চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরবেই।

 

গাজী মাজহারুল আনোয়ার [চলচ্চিত্রকার ও গীতিকার]

চলচ্চিত্র হলো মানুষের অন্তরকে প্রস্ফুটিত করার জায়গা। উন্নত গল্প, গান, সংলাপ আর বাণী দিয়ে মানুষের মনকে নাড়া দেওয়া যায় একমাত্র চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। বর্তমানে চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে নানা কারণে বিভাজনের ফলে এই সুন্দর অবস্থা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। এখন ছবি দেখে বের হয়ে কেউ সেই ছবির গল্প বলতে বলতে বাড়ি ফেরে না। সংলাপ মনে রাখে না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন গান প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছতে হবে। না হলে সেই গানের কোনো সার্থকতা নেই। এখন কি সেই গান, গল্প, সংলাপ হচ্ছে। মনে হয় না। তাই তো দেশীয় চলচ্চিত্র তার কৌলিন্য হারিয়েছে। আমাদের চলচ্চিত্র পিছিয়ে পড়েছে। আমরা এখন সংগঠন তৈরিতে উন্মুখ। এই সংগঠন কী গান, গল্প, সংলাপ উন্নত করতে পারবে? সার্বিকভাবে চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য আন্দোলন করতে হবে। এই আন্দোলন হবে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এদেশের মাটি ও মানুষের কথা বলার আন্দোলন। তা হলে নিশ্চিতভাবে চলচ্চিত্র শিল্পের সুদিন ফিরবে।

 

সুচন্দা [চলচ্চিত্রকার]

চলচ্চিত্র হলো একটি দেশ আর সমাজের আয়না। এই আয়নায় মানুষ তার নিজের জীবন আর পারিপার্শ্বিকতার চিত্র দেখবে। বিনোদন আর বাণীর মাধ্যমে মন আর জীবনকে উন্নত করবে। চলচ্চিত্র যেমন একটি দেশের প্রধান গণমাধ্যম ঠিক তেমনি এটি মেধা আর মনন চর্চার ক্ষেত্র। একে কোনোভাবে কলুষিত করা যাবে না। আমাদের সময় চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কোনো দল বা সংগঠনের দরকার ছিল না। সবাই মিলে মিশে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতাম বলেও কালজয়ী কাজ দিয়ে দেশীয় চলচ্চিত্র ভাণ্ডারকে পূর্ণতা দিয়েছি, দর্শকের মনেও চিরন্তন আসন গড়ে নিয়েছি। আসল কথা হলো মানুষের কাজ হলো তার পরিচয়। অন্য কিছু নয়। তাই সব বাদ দিয়ে একত্রিত হয়ে এই শিল্পের কল্যাণে কাজ করতে হবে। বিচ্ছিন্ন হয়ে হয়তো সাময়িকভাবে ব্যক্তি বিশেষের লাভ হতে পারে কিন্তু সমষ্টিগত কোনো উন্নয়ন হবে না। তাই এখনো সময় আছে বিভাজনের মানসিকতা থেকে সবাইকে বেরিয়ে এসে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

 

অনুপম হায়াৎ [চলচ্চিত্র গবেষক, সাংবাদিক]

চলচ্চিত্রে যত সংগঠনই হোক ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়া এই শিল্পের উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। পদ-পদবি আর সংগঠন দিয়ে কি চলচ্চিত্রের উন্নয়ন হয়? চলচ্চিত্রের ভালোত্বের জন্য প্রয়োজন ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ। চলচ্চিত্রের জন্মলগ্নে যারা নামি নির্মাতা আর শিল্পী ছিলেন তারা কী সংগঠন করেছেন? নাকি ভালো কাজ দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন? আবদুল জব্বার, জহির রায়হান, এহতেশাম, মুস্তাফিজ, কামাল আহমেদ, আমজাদ হোসেন, কাজী জহির, সুভাষ দত্ত, মিতা, রহমান, আজিম, সুজাতা, সুচন্দা, শাবানা, ববিতা, রাজ্জাক প্রমুখরাতো কোনো সংগঠন বা দলাদলিতে ছিলেন না। তারা শুধু ভালো কাজ করে গেছেন এবং এ কারণে এখনো দর্শক হূদয়ে তারা বেঁচে আছেন। এখন চলচ্চিত্রের নামে গ্রুপিং আর মারপিট কেন হবে? চলচ্চিত্র হচ্ছে নান্দনিকতার স্থান। চলচ্চিত্রে দেশ আর সমাজের নানা চিত্র ফুটে উঠবে। মানুষ বিনোদন আর বাণী পাবে। এতে দেশ আর সমাজ উপকৃত হবে। এদিকে লক্ষ্য না রেখে এসব সংগঠন করে চলচ্চিত্রের মধ্যে বিভাজন তৈরিতে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা থাকতে হবে, না হলে এভাবে চলতে থাকলে এর ধ্বংস অনিবার্য।

 

রোবায়েত ফেরদৌস

[আধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

দেশে এখন সব ক্ষেত্রেই বিভাজন সুস্পষ্ট।  শুধু চলচ্চিত্র নয়, পেশাজীবীদের মধ্যেও  এই বিভক্তি চলছে। আইন, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা মানে এক কথায় সব পেশার ক্ষেত্রেই চলছে এই বিভক্তির অপতত্পরতা। পদ-পদবি, আধিপত্য, ব্যক্তিগত ঈর্ষা, ক্ষমতার লোভ প্রতিটা সেক্টরকে দ্বিধাবিভক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ভালো কাজের স্পৃহা এতে কমে যাচ্ছে। ভালো কাজের সংখ্যাও কমছে। কারণ সবাই যখন দলাদলিতে তত্পর তখন ভালো কাজ হবে কোথা থেকে। একটা সময় কিন্তু আমাদের দেশে এ অবস্থা ছিল না। সবাই কাজকে ভালোবেসে ও প্রাধান্য দিয়ে এগিয়েছে বলে প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নত কাজ হয়েছে আর সংশ্লিষ্ট সবাই প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে। এখন এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে বলে সর্বত্রই অবক্ষয়ের সুর বেজে উঠছে। চলচ্চিত্র হচ্ছে একটি দেশের প্রধান গণমাধ্যম। তাই চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এ বিভাজন কারও কাম্য নয়। এটি পরিবারের জন্য যেমন দুঃখজনক তেমনি ফোরামের জন্যও দুঃখজনক। সবচেয়ে বেশি দুঃখজনক চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য। যা কারও কাম্য নয়।

 

সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড [চলচ্চিত্র নির্মাতা]

চলচ্চিত্রের উন্নয়নের স্বার্থে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করা বাঞ্ছনীয়। এমনিতেই দেশীয় চলচ্চিত্রের দুঃসময় যাচ্ছে। এরমধ্যে আবার ফোরাম আর পরিবারের নামে এই বিভক্তি আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। এখন সময় হচ্ছে একসঙ্গে কাজ করে দর্শককে কীভাবে চলচ্চিত্রের কাছাকাছি আনা যায় সেই চেষ্টা করা। চলচ্চিত্র যেহেতু একটি দেশের প্রধান গণমাধ্যম তাই এর উন্নয়নে সবার একতা দরকার এবং তাই হওয়া উচিত। আমাদের আন্দোলন, সংগ্রাম, কর্মপরিকল্পনা সবই হওয়া দরকার চলচ্চিত্র শিল্পের মঙ্গলের জন্য। না হলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বলে পৃথিবীতে কিছুই থাকবে না।

 

সর্বশেষ খবর