বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

খান আতাকে নিয়ে যত বিতর্ক

আলী আফতাব

খান আতাকে নিয়ে যত বিতর্ক

ফারুক - সোহেল রানা - নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু - আগুন

নাট্যব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর একটি মন্তব্য নিয়ে এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক। তিনি প্রখ্যাত অভিনেতা, সংগীত পরিচালক, গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার প্রয়াত খান আতাউর রহমানকে ‘রাজকার’ বলে মন্তব্য করেছেন। আর সেই মন্তব্যের ভিডিও অনলাইন দুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘‘খান আতা অনেক বড় শিল্পী। কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু খান আতা রাজাকার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি না হলে খান আতা বাঁচত না। আমি গৌরব করে বলি, আমি না হলে খান আতা একাত্তরে মারা যায়, ১৬ ডিসেম্বরের পরে। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ এটা নেগেটিভ ছবি। মুক্তিযোদ্ধাদের বলছে আবার তোরা মানুষ হ। আরে তুই মানুষ হ। তাই না! তুই তো রাজাকার ছিলি।” তার এমন মন্তব্যে অনলাইন দুনিয়ায় ভক্তদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কোনো অনুষ্ঠানে সবার সামনে প্রয়াত সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এমন মন্তব্য কতটা যৌক্তিক তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে অনেকের মধ্যে। আবার কেউ কেউ বাচ্চুর মন্তব্য সমর্থনও করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খান আতাউর রহমানের সন্তান প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা আগুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি চাই, বাচ্চু চাচার সেই ভিডিও ক্লিপটি ভাইরাল হোক। জনগণ তা দেখে রায় দেবে। যেহেতু আমার বাবা জনগণের কাছের একজন মানুষ, সেক্ষেত্রে তাদের প্রতিক্রিয়া জানার পরে প্রয়োজনে আমি প্রেস কনফারেন্স করব। আপাতত এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই আমার।’

অন্যদিকে আগামী ১৯ অক্টোবর বেলা ১১টায় বিএফডিসির জহির রায়হান কালার ল্যাবের সামনে এ সংবাদ সম্মেলন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ সময় ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমাটিও প্রদর্শন করা হবে। চলচ্চিত্র পরিবারের আহ্বায়ক চিত্রনায়ক ফারুক বলেন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু কে বা কি করেন তাতে আমার কোনো যায় আসে না। খান আতার মতো একজন গুণী মানুষকে তার গুণ প্রকাশ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তার সঙ্গে আমি অনেক কাজ করেছি। তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। তার মধ্যে যে দেশপ্রেম দেখেছি তা সত্যিই অভাবনীয়। তার কাজই তার প্রমাণ। তার মতো একজন মানুষকে আক্রমণ করে কথা বলা অনেক দুঃখজনক। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কথা বলেছে। এইখানে দেখা গিয়েছে ‘বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটি ছেলে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে বাসায় গিয়ে যখন দেখে, তার বাবা অসুস্থ। চারদিকে হাহাকার। বাইরে এসে দেখে এক শ্রেণির মানুষ চোরাকারবার করে গাড়ি, বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। এখন তার প্রশ্ন এরা কারা। আমরা অনেক কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করেছি। অথচ আমাদের কেন এই দুরবস্থা। তখন তারা অস্ত্র জমা দেয় না।’ বাচ্চু সাহেব এমন অবস্থা কখনো দেখেছে কিনা আমার জানা নেই। তিনি তো সুখে ছিলেন, সুখেই  আছেন। খান আতার মতো একটি মানুষকে কে না চিনেন। সব শ্রেণির মানুষ তাকে ভালোবাসেন। আমার প্রশ্ন হলো, বাচ্চু সাহেব আপনি যে খান আতাকে বলেন, ‘আগে তুই মানুষ হ’। আপনার মধ্যে কি এতটুকু আদব-কায়দা সেই, একজন মৃত, সিনিয়র, গুণী মানুষকে কি করে সম্বোধন করতে হয়? আপনি বলেছেন ৫০ জনের রাজাকারের তালিকায় খান আতার স্বাক্ষর আছে। প্রকৃত পক্ষে ওই তালিকা ছিল ৫৫ জনের। তাহলে বাকি পাঁচজনকে অন্য পকেটে রাখলেন কেন। তারা কারা আমরা সবাই তা জানি। তখন পাকিস্তানি সরকার বাঙালি মেধাবীদের বিপদে ফেলে রাজাকারের তালিকায় জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে ছিল। খান আতাও তাদের মধ্যে একজন। নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচাতে তিনি বাধ্য হয়ে এই স্বাক্ষর করেছিলেন। বাচ্চু সাহেব আপনি দেশের জন্য কি করেছেন, কতখানি করেছেন, আগে তা ভাবেন। তারপর এসব কথা বলুন। দেশ স্বাধীনের ৪৬ বছর পর কার ইঙ্গিতে খান আতাকে হেয় করে এসব কথা বলছেন? এটি ঠিক নয়। যদি পারেন আরেকটি খান আতা বানিয়ে দেখান। দু-একটি সিনেমা বানিয়ে কখনো ‘আবার তোরা মানুষ হ’ বা ‘সিরাজউদ্দৌলা’র খান আতা হওয়া যায় না। কারও বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ফারুকের মুখ বন্ধ রাখতে পারবেন না’।

এ প্রসঙ্গে সোহেল রানা বলেন, আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের দাবি করি, আদর্শগতভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধ কয়জন করেছি? বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা ছিল জীবন বাঁচাতে গিয়ে যুদ্ধ করেছে। তাদের যুদ্ধ ছাড়া কোনো পথ ছিল না। এর মধ্যে ২০ ভাগ লোক ছিল যারা সত্যিকারভাবে মুক্তিযুদ্ধ বুঝে যুদ্ধে গিয়েছিল। আমি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে অনুরোধ করব ১৯৬৯ সালে রেডিও পাকিস্তানে প্রচারিত গানগুলো শোনার জন্য। ২৫ মার্চের আগে এখানকার রেডিও ও টেলিভিশনে যে গানগুলো প্রচারিত হয়েছিল তার ৩০ ভাগ গানের লেখক ও সুরকার খান আতাউর রহমান। এই গানগুলো যেন তিনি দয়া করে শোনেন। গানগুলোতে কী ছিল? গানগুলোতে কি পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ ছিল না আমাদের দেশের কথা ছিল? তখন বাচ্চু সাহেবকে কেউ চিনত না কিন্তু খান আতা সাহেবকে সবাই চিনত। পাকিস্তানিরা এ দেশের দশজন লোক চিনলে তার মধ্যে খান আতা একজন। ফলে বাচ্চু সাহেবের পালিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যতটা সহজ ছিল, খান আতা সাহেবের জন্য ততটা সহজ ছিল না। যে কারণে তিনি সরাসরি যুদ্ধে যেতে পারেননি। অনেকেই রয়েছে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে যেতে পারেননি। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য গান লিখেছেন,  অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য টাকা সংগ্রহ করেছেন, খাবার দিয়েছেন। পুলিশ, বিডিআর, আর্মি, শিক্ষক, চিকিৎসক ১৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত তারা বেতন নিয়েছেন কার কাছ থেকে? পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে। এখন তাই বলে কি তারা রাজাকার? বাচ্চুকে শুধু একটি কথাই বলব, খান আতাকে রাজাকার বলার আগে একশবার ভাবা উচিত ছিল যে কাকে তুমি রাজাকার বলছ? স্বাধীনতার পরপর কয়েকজন শান্তিনগরে খান আতাকে ‘রাজাকার’ হিসেবে আটক করেছিল। তাকে মেরে ফেলবে। তখন আমি ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমি খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হই। আমি ওদের ১৫ জনকে পিটিয়ে আতা সাহেবের কাছে মাফ চাইতে বাধ্য করেছিলাম।

সর্বশেষ খবর