শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ওয়ার্ক পারমিটের তোয়াক্কা নেই

আলাউদ্দীন মাজিদ

ওয়ার্ক পারমিটের তোয়াক্কা না করেই বাংলাদেশে বিদেশি শিল্পী, নির্মাতা, কলাকুশলীদের কাজের রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে। এই অনিয়ম এখন যেন নিয়মেই পরিণত হয়েছে। শুক্রবার সিলেটের সুনামগঞ্জে এমন ঘটনার আবারও পুনরাবৃত্তি ঘটল। ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া একটি ছবির কাজ করতে এসে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন কলকাতার নৃত্যপরিচালক বাবা যাদবসহ চার ভারতীয় কলাকুশলী।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায় কোনো দেশের নাগরিক অন্য কোনো দেশে কোনো কাজের জন্য যেতে চাইলে প্রথমে তাকে নিজ দেশের দূতাবাসকে তা অবহিত করতে হবে। দূতাবাস তা গমনেচ্ছুক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগমনেচ্ছুক ব্যক্তির বিষয়ে জানতে গোয়েন্দা সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দেবে। এই তদন্ত রিপোর্ট আবার স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে আগমনেচ্ছুক ব্যক্তির দূতাবাসের নিকট প্রেরণ করা হবে। দূতাবাস তখন ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে আবেদনকারীর আবেদন মঞ্জুর বা না মঞ্জুর করবে। এই প্রক্রিয়ার বাইরে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কোনো কাজের জন্য এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে যেতে পারবে না। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই নিয়ম না মানায় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঢাকাই চলচ্চিত্র শিল্প ও সরকার। বিদেশি শিল্পী, নির্মাতা, কলাকুশলীর অবৈধ এবং অবাধ আগমনের কারণে বেকার হচ্ছে স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলীরা। একই সঙ্গে কর বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এই অনিয়ম দূরীকরণে সরকারকে কঠোর হওয়ার দাবি জানিয়েছেন চলচ্চিত্রকাররা।

অভিযোগে জানা গেছে কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বিদেশি শিল্পীকে অনেক সময় বাংলাদেশি হিসেবে দেখিয়ে এখানে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। বিদেশি শিল্পীর এদেশে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজের ক্ষেত্র এখন চলচ্চিত্র ছেড়ে নাটকেও গড়িয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছর নিজের অভিনীত ছবি ‘ভয়ংকর সুন্দর’ মুক্তি  উপলক্ষে ঢাকায় আসেন কলকাতার অভিনেতা ও পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। এই ছবির কাজে এসে তিনি ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের জন্য নির্মিতব্য সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজে অভিনয়ের উদ্যোগ নেন। এ খবর পেয়ে নিয়ম না মেনে বাংলাদেশি নাটকে অভিনয়ের অভিযোগ করে থানায়  জিডি করেন পরিচালক ও অভিনেতা গাজী রাকায়েত। রাকায়েত বলেন, বিদেশি শিল্পী কলাকুশলীরা আসছেন ট্যুরিস্ট ভিসায়। এই জিডি পরমব্রতর বিরুদ্ধে নয়। এক্ষেত্রে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে যে বিশৃঙ্খলা চলছে তার বিরুদ্ধে এবং একটা কেইস হিসেবে ক্যান্ডি প্রোডাকশন যারা সিরিজটা করছে তাদের কথা উল্লেখ করে জিডি করেছি। যাতে ভবিষ্যতে এমন অবৈধ শুটিং  বন্ধ করা হয়। যেহেতু পরমব্রত ওই প্রোডাকশনের সঙ্গে জড়িত  সেজন্য তার নাম আসছে। আমরা চাই এখানে যারাই কাজ করতে আসবেন তারা অবশ্যই দুই দেশের নিয়ম মেনে করবেন। এদিকে মিডিয়ার লোকজনের অভিযোগ ‘শুধু চলচ্চিত্র বা নাটকই নয়, প্রায়শই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঢাকায় বিশেষ করে ভারতীয় শিল্পীদের নিয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়। বলিউডের অভিনেতা শাহরুখ খানসহ নামি-দামি অভিনেতা শিল্পীরাও ঢাকায় এসেছেন কনসার্টসহ নানা অনুষ্ঠানে।

এদিকে কমপক্ষে গত দুই বছর ধরে ঢাকার ছবিতে কলকাতার শিল্পীদের ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের অনেকেই  ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে চলচ্চিত্রে কাজ করছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ওয়াজেদ আলী সুমনের ‘মনে রেখ’ ছবিটি। এ ছবিতে অভিনয় করতে গত মার্চ মাসে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া আসেন কলকাতার শিল্পী ওম, রজতাভ দত্তসহ অনেকে। খবর পেয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়। এ নিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গনে চলছে তুমুল সমালোচনা। চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমান বলেন, ওয়ার্ক পারমিট এবং অনুমতি ছাড়া কেন বিদেশিরা এখানে কাজ করবেন। নিয়ম মেনে চলতে অসুবিধা কোথায়। আমরা বিদেশে কাজ করতে গেলে আগে অনুমতি নিয়ে নেই। এ বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। চলচ্চিত্রকার মতিন রহমান বলেন, ভিনদেশি শিল্পীরা দেশের টাকা নিয়ে যাচ্ছেন ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে। এসব অসাধু কর্মকাণ্ডের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে দেশীয় শিল্পীদের ক্যারিয়ার আজ হুমকির মুখে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চলচ্চিত্রকার অভিযোগ করে বলেন, নিয়মের তোয়াক্কা না করে বিদেশিরা কাজ করতে আসছেন বাংলাদেশে। ট্যুরিস্ট ভিসায় এদেশে এসে শুটিং করে যাচ্ছেন হরদম। অথচ নিজ দেশ ছেড়ে ভিন্ন কোনো দেশে কাজ করতে হলে আইন অনুযায়ী অবশ্যই তাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে ওয়ার্ক পারমিট নিতে হবে। কলকাতার শিল্পীদের বেশিরভাগই ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি তারা পারিশ্রমিকও নিচ্ছেন অবৈধ উপায়ে। বাংলাদেশ সরকারের প্রাপ্য ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারিশ্রমিক  নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যাংকিং সিস্টেমের বদলে হুন্ডিকেই  বেছে নিয়েছেন অনেকে। মানি লন্ডারিং করে দেশীয় অসাধু একটি চক্র ভারতীয় শিল্পীদের পারিশ্রমিক প্রদান করছেন।  কেউ কেউ আবার ট্যাক্স ফাঁকি দিতে কাগজে-কলমে নিজেদের পারিশ্রমিক দেখাচ্ছেন মাত্র ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। অথচ তাদের প্রত্যেকেই সর্বনিম্ন পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক নিয়ে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রখ্যাত গীতিকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, ‘নিয়ম না মানা আমাদের মধ্যে এক ধরনের সংস্কৃতি হয়ে গেছে। সবখানেই চলছে নিয়ম না মানার মহোৎসব। যে যার মতো ছবি বানাচ্ছেন। বিদেশি শিল্পী আনছেন। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না। বিদেশি  কোনো শিল্পী বাংলাদেশে কাজ করতে হলে অনুমতি কার কাছ  থেকে নিতে হবে এটাও অনেকে জানেন না। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এতে যে দেশকে হেয় করা হচ্ছে এটা বোঝার মতো মানুষ কোথায়? সবাই নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত।

সর্বশেষ খবর