শনিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

চাষী নজরুলকে খোলা চিঠি


চাষী নজরুলকে খোলা চিঠি

সাদা রংটা তার বড় প্রিয় ছিল, বলছি একুশে পদক পাওয়া প্রয়াত চলচ্চিত্রনির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের কথা। সত্যিকার অর্থে তিনি একজন সাদা মনের মানুষ ছিলেন। কণ্ঠের ভারিক্কি আর ভালোবাসা মাখা উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষটি ছিলেন রঙিন ভুবনে তারকা গড়ার কারিগর। সবার প্রিয় এ সাদা মনের মানুষটি আজ নিজেই দূর আকাশে তারা হয়ে সতীর্থদের চারপাশে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি সবার চোখে অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিয়ে ঊর্ধ্বলোকে বসত গড়েন তিনি। প্রিয় স্বামীকে হারানো বেদনার সাগরে ভাসা তার সহধর্মিণী চাষী নজরুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জ্যোত্স্না কাজী তার উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। চিঠিটি এখানে পত্রস্থ করা হলো—

 

প্রিয় চাষী,

তুমি কেমন আছো? ঘনকুয়াশার আবরণে ঢাকা আকাশটা। সূর্যলোক কখনো আসে, ফের চলে যায়। অনুভবের গায়ে শীতের পরশ লাগে। অপলক সময়ে সামনে এসে দাঁড়ায় ১১ জানুয়ারি। প্রিয় চাষী নজরুল, তোমার চির প্রস্থানের দিন। সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে ফুলের আবরণে তুমি সেজেছিলে ১১ জানুয়ারি ২০১৫। তখন চারপাশ গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা ফুলের সুবাসে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। লাল গোলাপের পাপড়ি তোমার সাদা কাপড়কে লাল করে রেখেছিল। চাষী, তুমি কোথায় চলে গেলে? মনে আছে তোমার? ১৯৬৯-এ দুজনে হাত ধরে পথ চলতে শুরু করেছিলাম। তখন কথা ছিল না আমাকে এভাবে ফেলে চলে যাবে তুমি। কেমন করে আছো তুমি আমাকে ছাড়া এভাবে একাকী? তোমার শূন্য বিছানা সারা রাত আমাকে তোমায় ঘেরা স্মৃতির অতলে নিয়ে যায়। তোমার কি মনে আছে আমি সাদা শাড়ি পরতাম, সাদা বিছানার চাদরে ঘুমাতাম, বিছানাটা টান টান করা থাকত, দুজন দুজনকে আলিঙ্গন করে শুয়ে থাকতাম। তোমার কি মনে আছে টিএসসিতে আমি, তুমি, খালেদ হাশেম, জয়নাল আবেদীন, কাউসার ইয়াজুল হক মিলে বাদাম-ঝালমুড়ি খেতাম? আর গল্পের মাধ্যমে তুমি পৃথিবী জয় করার চেষ্টা করতে। আমরা সবাই তন্ময় হয়ে তোমার কথা শুনতাম। আমি কখনো বক্তৃতা দিতে মঞ্চে দাঁড়ালে দৃষ্টি পড়ত তোমার দিকে, তুমি দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে। কখনো কখনো আমরা রাজপথ ধরে হাঁটতাম, ফুটপাথে ঝুপড়িঘর দেখলে থমকে দাঁড়াতে, বলতে ‘কী প্রশান্তি তাদের মাঝে’। কখনো আবার কুয়াশা ঢাকা রাতে আমরা রিকশা করে নান-কাবাব খেতে যেতাম। বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আমি কবিতা আবৃত্তি করতাম, তুমি হাসতে আবার কখনো আবেগী হয়ে যেতে। মনে আছে একদিন আমাদের গাড়ি যখন জাদুঘরের বিপরীতে জ্যামে দাঁড়িয়েছিল তখন অনেকগুলো বেলি ফুলের মালা আমার হাতে দিয়ে বললে, খোঁপায় সুন্দর করে পরে নাও। খোঁপায় ফুলগুলো লাগাতে লাগাতে একদৃষ্টিতে তোমার দিকে চেয়েছিলাম। এত মায়া যার, এত সুন্দরের পুজারি যে, সে কী করে আমাকে ৪৮ বছর পর ফেলে রেখে চলে গেল?

মনে পড়ে? এই মোবাইলের যুগে তুমি যেখানেই থাকতে দু’একবার আমাকে ফোন করতে। আজ তুমি কোথায় আছো? তুমি আগে বলতে যে প্রান্তে যাও একটা ক্যামেরা লাগিয়ে রাখবে। কে কী করে দেখার জন্য। আমরা দুজন হেসে উঠতাম। ছবির গল্প, স্ক্রিপ্ট নিয়ে গল্প শুটিং- এফডিসির আড্ডা নিয়ে গল্প করতে আমার সঙ্গে। আর সেভাবে এখন কেউ বলে না। চলচ্চিত্র অঙ্গনে কেউ যদি চলে যেত তুমি ছুটে যেতে। বিষণ্ন মুখে ঘরে ফিরে তুমি আমাকে বলতে, তোমাকে একা রেখে কোথাও যাব না। তুমি কথা রাখনি। বিক্রমপুরের জন্য তোমার একটা অদ্ভুত মায়া ছিল। সময় পেলে ছুটে যেতে। তখন আমাকে বুঝিয়ে বলনি- বিক্রমপুরের মাটিতে তুমি চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়বে। মাঝে মাঝে তোমাকে দেখার জন্য ছুটে যাই। দেখতে পাই সবুজ ঘাস। ঘাসগুলোর সজীবতা বলে দেয় তুমি ভালো আছো। আমি জানি সত্যি তুমি ভালো আছো, চিরদিন তুমি ভালো থেকো। এই কামনায় তোমারই প্রতীক্ষায় আছি এই একা আমি...।

 

            ইতি—

            তোমরাই

            জ্যোস্না কাজী

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর