শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ছবি সংকটে সিনেমা হল

আলাউদ্দীন মাজিদ

ছবি সংকটে সিনেমা হল

সাম্প্রতিক সময়ে দর্শকশূন্য দুটি সিনেমা হলের চিত্র। এমন চিত্র এখন দেশের প্রতিটি সিনেমা হলের। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে দর্শক সিনেমা হলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে বলে অভিযোগ সিনেমা হল মালিকদের

ছবির অভাবে ফের মহাসংকটে পড়েছে সিনেমা হলগুলো। বছরের প্রথম মাসে চারটি স্থানীয় ছবি মুক্তি পেলেও মানের অভাবে ছবিগুলোর ভরাডুবি হয়েছে। কলকাতা থেকে আমদানি করা ছবি দিয়েও পার পাওয়া যায়নি। মুক্তি পাওয়া স্থানীয় চার  ছবি হলো— ‘পুত্র’, ‘হৈমন্তী’, ‘পাগল মানুষ’ ও ‘দেমাগ’। আর আমদানিকৃত দুটি কলকাতার ছবি হচ্ছে— ‘জিও পাগলা’ এবং ‘ইন্সপেক্টর নটি কে’। ফেব্রুয়ারির প্রথম শুক্রবার কোনো ছবি মুক্তি পায়নি। গতকাল মুক্তি পায় ‘ভালো থেকো’ ছবিটি। প্রথম দিন ছবিটি মোটামুটি চলেছে বলে জানান প্রদর্শকরা। বছরের শুরুতেই ছবি ব্যবসার এই বেহাল দশায় শঙ্কিত চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী ও সিনেমা হল মালিকরা। দেশে বর্তমানে সিনেমা হলের সংখ্যা প্রদর্শক সমিতির তথ্যমতে ৩১৮টি। প্রদর্শক ও চলচ্চিত্র প্রযোজকরা বলছেন, মানহীন ছবির কারণে দেশীয় ছবির প্রতি দর্শকদের যে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে তাতে আগামীতে কীভাবে সিনেমা হলে দর্শক ফেরানো যাবে তা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদ বলছেন, বছরে দু-একটি ভালো ছবি দিয়ে তো সিনেমা হল টিকিয়ে রাখা যাবে না। সিনেমা হল চালাতে গেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ইলেকট্রিক ও পানির বিল, টেক্স, নানা মেনটেইন্যান্স খরচ মেটাতে প্রচুর টাকার দরকার। সিনেমা হলে দর্শক না এলে এই খরচ কীভাবে মেটানো হবে। জাজ মাল্টিমিডিয়ার চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ বলেন, বন্ধ প্রায় দেড় ডজন সিনেমা হল লিজ নিয়ে চালু করেছিলাম। প্রতিটির মাসিক আনুষঙ্গিক খরচ ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকা করে। অথচ ছবির অভাবে মাসে ৫০ দূরে থাক ৫ হাজার টাকা তুলে আনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। নিজে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণের মাধ্যমে এই অচলাবস্থা দূর করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু যৌথ প্রযোজনা নিয়ে নানা বিতর্কের কারণে এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। অথচ যৌথ আয়োজনের ছবিগুলো দিয়েই সিনেমা হলগুলো লাভের মুখ দেখছিল। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ— শিকারি, বাদশা, বস টু, নবাব, রোমিও ভার্সেস জুলিয়েট প্রভৃতি। এখন নতুন যে নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে তাতে যেসব শর্ত রয়েছে তা দিয়ে ছবি নির্মাণ করতে গেলে ব্যবসায়িক ঝুঁকি থেকেই যায়। আমি যৌথ প্রযোজনার নীতিমালার জন্য কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেগুলো বিবেচনায় আনা হয়নি। এই অবস্থায় আমার পক্ষে আর ছবি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। আমার প্রযোজনা প্রতূিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিচ্ছি। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, স্থানীয়ভাবে কয়েক বছরে একবার ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’ কিংবা ‘ঢাকা অ্যাটাকের মতো ছবি দিয়ে তো সিনেমা হলের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কলকাতার ছবি ওখানে মুক্তি পাওয়ার পর রপ্তানির বিপরীতে আমদানি করতে গিয়ে সরকারি নানা নিয়মনীতি পূরণে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। সেগুলো ওই সময়ের মধ্যে টিভি চ্যানেল, ইউটিউব ও সিডি-ডিভিডিতে চলে আসে। ফলে দর্শক তা এখানকার সিনেমা হলে আর দেখে না। যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রেও নানা সমস্যা তৈরি হয়েছে। স্থানীয়ভাবে কম বাজেটে ছবি তৈরি হয় বলে মানের অভাবে দর্শক তাও দেখে না। এ অবস্থায় সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে এখন সীমিত আকারে হলেও ভারতের সঙ্গে এখানে সরাসরি ছবি মুক্তি দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। চলচ্চিত্রকার আজিজুর রহমান বলেন, পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি নির্মাণ বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে সিনেমা হলের সংখ্যা এখন তলানিতে এসে ঠেকছে। মাঝে-মধ্যে টানা কয়েক সপ্তাহ ছবি মুক্তি পায় না। সব মিলিয়ে চলচ্চিত্র ব্যবসা এখন মহাসংকটের মুখোমুখি। চলচ্চিত্র নির্মাতা ছটকু আহমেদ বলছেন, ছবি নির্মাণ কমছে। যাও নির্মাণ হচ্ছে তাও মানের অভাবে দর্শক দেখে না। ফলে লগ্নিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর ছবি ব্যবসার এমন দুর্দিন দেখে প্রযোজকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আর এগিয়ে আসছেন না। এ অবস্থায় চলচ্চিত্র ব্যবসা আগামীতে কীভাবে টিকে থাকবে তা বুঝতে পারছি না। টিওটি ফিল্মসের কর্ণধার খোরশেদ আলম খসরুর কথায়, লোকসান গুনতে গিয়ে বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির নির্বাচনও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। ফলে সমস্যার আর কোনো সমাধান হচ্ছে না। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে চলচ্চিত্র ব্যবসাকে এগিয়ে নেওয়া কীভাবে সম্ভব? এদিকে চলতি বছর বেশকিছু দর্শক আগ্রহের ছবি মুক্তির মিছিলে থাকলেও ছবিগুলো কতটা দর্শক আনুকূল্য পাবে তা এসব ছবি মুক্তির পরই বোঝা যাবে বলে চলচ্চিত্রকারদের মন্তব্য। যেসব ছবি নিয়ে দর্শক-নির্মাতারা এখন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো— স্বপ্নজাল, বিজলি, আমি নেতা হব, ভালো থেকো, পোড়ামন-২, পাষাণ, নূরজাহান, একটি সিনেমার গল্প, আব্বাস, নোলক, দেবী, যদি এক দিন, অপারেশন অগ্নিপথ, সুপার হিরো, নোয়াখাইল্লা মাইয়া চিটাগাংইয়া পোয়া, অন্ধকার জগৎ প্রভৃতি। চলচ্চিত্রকার ও প্রদর্শকদের মতে, চলতি বছর এ ছবিগুলোই নির্ধারণ করে দেবে দেশীয় চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর