রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান

আলাউদ্দীন মাজিদ

হারিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান

‘ওরে সাম্পানওয়ালা’, ছোড ছোড ঢেউ তুলি, সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি দিওয়ানা, নাতিন বরই খা, যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, কইলজার ভিতর বান্ধি রাইখ্যুম তোঁয়ারে, আঁরা চাটগাইয়া নওজোয়ান, মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা— এসব গান শুনলেই আমাদের দেশের গানের ভাণ্ডারের পরিপূর্ণতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আঞ্চলিক গানের এই গর্ব আর প্রাপ্তি বাংলাদেশের দক্ষিণ জনপদ সমৃদ্ধ চট্টগ্রামের। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের শুরু স্বাধীনতার বহু আগে থেকে। এই আঞ্চলিক গান শুধু চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ থাকেনি, দেশের গণ্ডিও ছাড়িয়েছে। হয়েছে প্রশংসিত। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, নব্বই দশকের পর থেকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান আগের মতো আর বিস্তৃত হচ্ছে না। আঞ্চলিক গানের অন্যতম সম্রাজ্ঞী কল্যাণী ঘোষ বলেন, ‘আমাদের গান এখন বিস্তৃত না হলেও বিস্মৃত হয়ে যায়নি। এখনকার শিল্পীরা গাইছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে মৌলিকত্বের অভাব রয়েছে। তারা পুরনো গানগুলোই গাইছেন। তারা মঞ্চে উঠলে শুধু আঞ্চলিক নয়, শুদ্ধ আর আধুনিক, মানে পাঁচমিশালি গান করছেন। আমরা এখনো যেখানে যাই আঞ্চলিক আর মাইজভাণ্ডারী ছাড়া অন্য কোনো গান করি না। অথচ আঞ্চলিক গান আমার মতো অনেক শিল্পীকে এনে দিয়েছে সুনাম আর অর্থবিত্ত। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিইনি, তখন আমি ছোট ছিলাম। কিন্তু গানের যুদ্ধ দিয়ে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের আরেক জনপ্রিয় শিল্পী কান্তা নন্দী বলেন, ‘আঞ্চলিক ভাষার বিবেচনায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানই সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। গানের ভাব-ভাষা, আবেদন সুর এবং জীবনের নান্দনিকতায় এ অঞ্চলের গান স্বমহিমায় অদ্বিতীয়।  জীবন, পেশা, প্রকৃতি ও পারিবারিক জীবনের সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্পর্ক পাকাপোক্ত। যদিও চট্টগ্রামের লোকেরাই আজকাল সেসব ভুলতে বসেছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে এখন ধরে  রেখেছে বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্র। আঞ্চলিক গানের স্রষ্টা শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের মৃত্যুর পর বর্তমানে দুই জনপ্রিয় শিল্পী কল্যাণী ঘোষ আর সনজিৎ আচার্য চট্টগ্রামের গানকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি এখন ঢাকায় থাকি, তারপরও যেখানে গাইতে যাই চট্টগ্রামের গানকেই উপস্থাপন করি। গত শুক্রবার ঢাকা বইমেলায় চট্টগ্রামের গানই করেছি।’

আঞ্চলিক গানের আরেক জনপ্রিয় শিল্পী কল্যাণী ঘোষের পুত্র মিঠুন চক্রবর্তীর কথায়, ‘আঞ্চলিক গান আমার অস্তিত্ব। আমার পরিচয় প্রথমত আমি বংলাদেশি, দ্বিতীয়ত আমি চট্টগ্রামের সন্তান এবং শিল্পী। আমি চট্টগ্রামের গানকে প্রাণ দিতে অন্য কোনো চাকরি, ব্যবসা অথবা কোনো পেশায় যুক্ত হইনি। চট্টগ্রামের গানে রয়েছে স্ট্রং ওয়ার্ড ও মেলোডি। এই গান সব সময়ই স্ট্যান্ডার্ড। আমার মা প্রায় ৩৫ বছর ধরে গান করছেন। আমার রক্তেও মিশে আছে চট্টগ্রামের গান নিয়ে শতভাগ দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। মিঠুন পরিচিতি পেয়েছেন পারকাশন বা তবলা বাদক হিসেবে। এ আর রহমানের সঙ্গেও বাজিয়েছেন তিনি। চট্টগ্রামের কিংবদন্তি গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী সঞ্জীত আচার্যের জনপ্রিয় ‘বাঁশখালী মইষখালী’ গানটিতে নতুনভাবে কণ্ঠ দিয়েছেন মিঠুন। গাওয়ার পাশাপাশি এর সংগীতায়োজন তারই। ডিজিটাল আকারে বের হয়েছে ‘সাম্পানওয়ালা’ শিরোনামের গানটি। এই শিল্পী জানান, একই সংগীতকারের আয়োজনে তার দ্বিতীয় গান ‘দাওয়াত’ শিগগিরই প্রকাশ হবে। তার কথায়, বর্তমানের শিল্পীদের মধ্যে আঞ্চলিক গানের প্রতি আগ্রহ কম। তারা অন্য সংস্কৃতিকে ব্যাটার মনে করে। তা ছাড়া এখন অ্যালবাম নেই। চলছে সিঙ্গেল ট্র্যাক। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আঞ্চলিক গানের ঐতিহ্য।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি ছিলেন শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। তাদের কণ্ঠ ও গায়কীর জোরে এসব গান এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, সারা দেশেই এসব গান ছড়িয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া কল্যাণী ঘোষ, সনজিৎ আচার্য, কান্তা নন্দী, এম এন আক্তার, সন্ধ্যারানী দাশ, লক্ষ্মীপদ আচার্য, এম এন নূরুল আলম, নূরুল ইসলাম তালুকদার, রশিদ নিজামী, সিরাজুল ইসলাম আজাদ, প্রেম বৈষ্ণব, দীপক আচার্য, মিলন আচার্য , গীতা আচার্য, ফারুক হাসান, মানস পাল, ইকবাল হায়দার, গীতা আচার্য, পূর্ণিমা দাশ, সৈয়দ মহিউদ্দীনের মতো শ্রোতাপ্রিয় গীতিকার ও শিল্পীরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে প্রাণ দিয়ে এসেছেন এবং দিচ্ছেন। আর অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, অজিত বরণ শর্মা, অমলেন্দু বিশ্বাস, আবদুল গফুর হালি, আসকর আলী পণ্ডিত, ইয়াকুব আলী, কাজল দাস, খায়রুজ্জামান পণ্ডিত, কবিয়াল ফনী বড়ুয়া, মলয়ঘোষ দস্তিদার, রমেশ শীল, সনজিৎ আচার্য, মোহাম্মদ নূরুল আলম, মোহনলাল দাস, এম এন আক্তার, সেকান্দর পণ্ডিত প্রমুখের কথা ও সুরে চট্টগ্রামের গান অনন্য উচ্চতায় সমাসীন হয়েছে। চট্টগ্রামের কালজয়ী আঞ্চলিক গানের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো- ছোড  ছোড ঢেউ তুলি, লুসাই পাহাড়তুল লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী। ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে,  অভাগিনীর দুঃখের কথা কই বন্ধুরে। শঙ্খনদীর সাম্পান আঁর মন কাড়ি নিলো। ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা। সোনা বন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা মনেতো মানে না, দিলেতো বুঝে না। যদি সুন্দর একখান মন পাইতাম, যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম, মহেশখালীর পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম। কইলজার মইধ্যে বান্ধি রাইখুম তোঁয়ারে। বানুরে, জি, আঁই যাইয়ুম রেঙ্গুন শহর তোয়ালাই আইনুম কী? আঁরা চাটগাইয়া নওজোয়ান, দইজার কুলাত বসতকরি সিনায় ঠেকাই ঝাড়তুফান। সূর্য উঠেরে ভাই লালমারি, রইস্যা বন্ধু  গেল আঁর বুকত সেল মারি। ও পরানের তালতো ভাই। পাঞ্জাবি ওয়ালারে দিলে বড় জ্বালা, দিলে বড় জ্বালারে লাল কোর্তা ওয়ালা প্রভৃতি। বর্তমানে চট্টগ্রামের মানুষের একটিই আক্ষেপ এমন গান আর হচ্ছে না। নতুন বা পুরনো শিল্পীরা পুরনো গানগুলোই শুধু গেয়ে যাচ্ছেন। নতুন সৃষ্টির অভাবে একদিন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান একেবারেই হারিয়ে যেতে পারে বলে চট্টগ্রামবাসীর আশঙ্কা।

 

 

সর্বশেষ খবর