শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমাদের বাউল সাধক

আমাদের বাউল সাধক

বাউলকুল শিরোমণি লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে বাউল পরিচিতি লাভ করে। বাউল গান যেমন জীবন দর্শনে সম্পৃক্ত তেমনি সুর সমৃদ্ধ। বাউলদের সাদামাটা কৃচ্ছ্রসাধনার জীবন আর একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাদের অভ্যাস। বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক। সাধারণত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেছেন। লিখেছেন— পান্থ আফজাল

 

লালন সাঁই

লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুলের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি  দেওয়া হয়েছিল।

হাসন রাজা

হাসন রাজার প্রকৃত নাম দেওয়ান হাসন রাজা। বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহে্র প্রধান পথিকৃৎ। দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার। ‘হাছন উদাস’ গ্রন্থে তার ২০৬টি গান সংকলিত হয়েছে। হাসন রাজার আর কিছু হিন্দি গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়। মরমি গানের ছক-বাঁধা বিষয় ধারাকে অনুসরণ করেই হাসনের গান রচিত।

শাহ আবদুল করিম

শাহ আবদুল করিমের গান ভাটি অঞ্চলে জনপ্রিয় হলেও শহরের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পান। প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছেন। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহের দর্শন থেকে। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।

পাগলা কানাই

পাগলা কানাই বা কানাই শেখ আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনার সাধক-অসংখ্য দেহতত্ত্ব, জারি, বাউল, মারফতি, ধুয়া, মুর্শিদী গানের স্রষ্টা। এই স্বভাব কবির সর্বাপেক্ষা পদচারণা ছিল ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। পরবর্তীতে তিনি ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফিরে পাবনা ও সিরাজগঞ্জে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। 

মুকুন্দ দাস

মুকুন্দ দাস স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় বহু স্বদেশী বিপ্লবাত্মক গান ও নাটক রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন স্বদেশী যাত্রার প্রবর্তক। গান, কবিতা ও নাটক রচনা করে বাঙালির জাতীয় জীবনে নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার করেন। কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা মায়ের দামাল ছেলে চারণ-সম্রাট মুকুন্দ উপাধিতে ও সন্তান আখ্যায় ভূষিত করেন।

রাধারমণ দত্ত

রাধারমণ দত্ত হলেন একজন বাংলা সাহিত্যিক, সাধক কবি, বৈঞ্চব বাউল, ধামালি নৃত্যের প্রবর্তক। সংগীতানুরাগীদের কাছে তিনি রাধারমণ এবং ভাইবে রাধারমণ বলেই সমাধিক পরিচিত। বাংলা লোকসংগীতের পুরোধা লোককবি রাধারমণ দত্ত। তার রচিত ধামাইল গান সিলেট ও ভারতের বাঙালিদের কাছে পরম আদরের ধন। রাধারমণ নিজের মেধা ও দর্শনকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।

 

উকিল মুন্সি

প্রকৃত নাম আবদুল হক আকন্দ। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি বড় ছিলেন। ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে জালালপুর গ্রামে বিয়ে করে সেখানেই বসতি স্থাপন করেন । ১৯১৮ সালের ১৭ এপ্রিল তার প্রথম সন্তান প্রখ্যাত বাউল গায়ক আবদুস সাত্তার জন্ম নেন। উকিল মুন্সি বাউল গান ছাড়াও মালজোড়া, তত্ত্বগান ও বিচ্ছেদ গানের জন্যও সুপরিচিত ছিলেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করেছেন। তিনি ১৯৭৮ সালের ৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

 

রজ্জব আলী দেওয়ান

রজ্জব আলী দেওয়ান ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাজেলার অন্তর্গত চর্চনপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার একান্ত আগ্রহই তার গানের প্রেরণা। তিনি পীর মৌলভী মো. দয়াল আবদুল কাদের শাহ চিশতীর কাছে বায়াত নেন এবং গুরুর আদেশে ১৯৬৬ সাল থেকে গান লেখা, চর্চা ও পেশাগতভাবে গান পরিবেশনা শুরু করেন। রজ্জব আলী দেওয়ান মরমি সংগীতের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। তার রচিত অসংখ্য গান বেতার ও টেলিভিশনে বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে আজও শোনা যায়। ১৯৯২ সালে এ সুরের সাধক পরলোক গমন করেন।

ফকির দুর্বিনশাহ

ফকির দুর্বিন শাহ যাকে ছাড়া সিলেটের মরমি সাহিত্যের কল্পনা করা যায় না। মরমি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ জ্ঞানের সাগর ফকির দুর্বিন শাহর গানের ভাব ও বিষয়বস্তু বাহ্যিক দৃষ্টিতে পার্থিব বিষয়ক মনে হলেও বাস্তবিকপক্ষে এগুলো  আধ্যাত্মিক। ১৯৬৮ বিলাত ভ্রমণে অন্যতম সফর সঙ্গী ছিলেন বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম। সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন। ১৯৭৮ প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র ’যুক্তি তক্কো গপ্পো’-তে তার নামাজ আমার হইল না আদায় আল্লাহ’ শীষক গানটি ব্যবহৃত হয়। এটি গেয়েছিলেন শিল্পী রণেন রায় চৌধুরী।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর