মঙ্গলবার, ২৭ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
ইন্টারভিউ

দেশে বন্ধ করে জাজ মাল্টিমিডিয়া কলকাতায় চালু করব না

আবদুল আজিজ প্রযোজক, চেয়ারম্যান- জাজ মাল্টিমিডিয়া

 দেশে বন্ধ করে জাজ মাল্টিমিডিয়া কলকাতায় চালু করব না

ঢাকাই চলচ্চিত্রের বর্তমান মুভি মুঘল খ্যাত প্রযোজক আবদুল আজিজ তার প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়া সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে এবং চলচ্চিত্র শিল্পে তার ভূমিকা ও এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে আবদুল আজিজ কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

জাজ মাল্টিমিডিয়া বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন, কেন?

বর্তমানে এদেশে চলচ্চিত্রের ব্যবসা খুবই করুণ। দুবছর আগেও যেখানে একটি ছবির গড় আয় ছিল ২৭ লাখ টাকা সেখানে এই অংক এখন ১০ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। আর আন্তর্জাতিক মানের ছবি নির্মাণে ব্যয় হয় কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা। কিন্তু এদেশে ছবিপ্রতি আড়াই কোটি টাকার বেশি আয় করা সম্ভব নয়। আয়-ব্যয়ের এই ফারাকের কারণে আর কত লোকসান গুনব। তাই বাধ্য হয়েই ছবি নির্মাণ মানে জাজ মাল্টিমিডিয়া বন্ধ করে দিচ্ছি। কয়েকটি ছবির কাজ চলমান আছে, সেগুলো রিলিজ দিয়ে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে দূরে সরে যাব।

 

জাজ মাল্টিমিডিয়া ইন্ডিয়া লিমিটেড নামে কলকাতায় নাকি প্রতিষ্ঠানটি চালু করতে যাচ্ছেন?

এ খবর মোটেও সত্যি নয়। দেশে বন্ধ করে জাজ মাল্টিমিডিয়া কলকাতায় চালু করব না।

 

অনেকের কথায় যৌথ প্রযোজনার নতুন নীতিমালা পছন্দ না হওয়ায় অভিমান করেই জাজ বন্ধ করে দিচ্ছেন?

যৌথ প্রযোজনার নতুন নীতিমালা মেনে ছবি নির্মাণ করা সত্যিই ডিফিকাল্ট। এই নীতিমালা তৈরির কমিটিতে কোনো প্রযোজককে রাখা হয়নি। আমলা, শিল্পী আর কলা-কুশলীরা মিলে এটি তৈরি করেছে। তাই এতে নির্মাণের যথাযথ নিয়মকানুন অনুপস্থিত রয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে পণ্য মাপা যায়, শিল্প নয়। শুধু এ কারণে নির্মাণ বন্ধ করছি, তাও ঠিক নয়।

 

তাহলে অন্য কারণগুলো কী?

আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে ঐক্যের বড় অভাব। এই শিল্পে পরস্পরের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে বাংলাদেশের অন্য কোনো সেক্টরে তা নেই। এখানে চলচ্চিত্রের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। চলচ্চিত্র জগতের কিছু লোক জাজকে অহেতুক প্রতিপক্ষ মনে করে। অনেকের ধারণা জাজের কারণে তাদের ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে। জাজ ডিজিটাল নির্মাণ ও প্রদর্শন চালু করায় অনেকে এই আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না। তাই জাজকে তারা অযৌক্তিকভাবে ক্ষতিকর মনে করছে।

 

এত প্রতিকূলতা জেনেও লোকসান গোনা কেন?

দেখুন, একটি দেশের প্রধান গণমাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিনোদনের পাশাপাশি দেশ, সমাজ ও পরিবারের জন্য কল্যাণকর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। দেশ ও জনগণের মঙ্গলের জন্য চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছিলাম। এই শিল্পকে ভালোবেসেছি বলে লাভ-লোকসান ছিল আমার কাছে তুচ্ছ। নব প্রযুক্তি, নতুন মুখ আর বিশ্বমানের নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বদরবারে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছি। অনেকটা সফলও হয়েছি। ‘শিকারি’ আর ‘নবাব’সহ জাজের অনেক ছবি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা ও স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম কোনো বাংলা ছবি হিসেবে ‘নবাব’ প্রদর্শিত হয় এবং ব্যাপক সাড়া জাগায়। এতকিছুর পরও যখন কেউ কেউ জাজের বিরোধিতা করে তখন সত্যি খুব দুঃখ হয়।

 

চলচ্চিত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?

এক কথায় এই শিল্প এখন কোমায় চলে যাচ্ছে। আগামী ঈদের পর ছবির অভাবে কমপক্ষে আরও ত্রিশটি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাবে। সিনেমা হল না থাকলে টাকা খরচ করে  জেনেশুনে কেউ লোকসান গুনতে যাবে না। সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে বছরে কমপক্ষে ৬০টি ছবি দরকার। এর মধ্যে ২০টি হতে হবে বড় মাপের ছবি। এই অবস্থা এখন আর নেই। আর এই নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছে একমাত্র অনৈক্যের কারণে। তাই নিশ্চিতভাবে দেখা যাচ্ছে, এই শিল্প এখন বন্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

 

সিনেমা হলে জাজ স্থাপিত প্রজেক্টর এবং এর ভাড়া নিয়েও বিতর্ক আছে, কি বলেন?

দেখুন, ব্যবসা করার জন্যই তো সিনেমা হলে প্রজেক্টর স্থাপন করেছি। আমার প্রতিটি প্রজেক্টর এইচ ডি মানের। কলকাতায় একটি হল থেকে প্রজেক্টরের ভাড়া নেওয়া হয় ১৮ হাজার রুপি। মানে বাংলাদেশি টাকায় ২২ হাজার টাকা। আর আমি নিচ্ছি গড়ে প্রতি সিনেমা হল থেকে মাত্র ৬ হাজার টাকা করে। যে ভাড়া নিচ্ছি তা দিয়ে অফিস পরিচালনার খরচই ওঠে না। তারপরও চলচ্চিত্র শিল্পকে ভালোবেসেই এই সাবসিডি দিয়ে যাচ্ছি। চলচ্চিত্রের মঙ্গলে কাজ করাটাই তাহলে কি আমার অপরাধ?

 

চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির বিরোধে দীর্ঘদিন এতে নতুন কমিটি নেই, এ বিষয়ে কিছু বলবেন?

প্রযোজক সমিতিকে নিয়মতান্ত্রিক হওয়া উচিত। এখানে ক্ষমতার লোভ থাকায় অচলাবস্থা চলছে। চলচ্চিত্রের উন্নয়ন চাইলে এখানে ব্যক্তিস্বার্থ বাদ দিতে হবে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে নির্বাচিত কমিটি দিয়ে সমিতি পরিচালনার বিকল্প নেই।

 

বর্তমানে যৌথ প্রযোজনার ছবি সাফটা চুক্তির আওতায় আমদানি করা হচ্ছে, কেন?

এটি নতুন যৌথ প্রযোজনার অনিয়মের কারণেই হয়েছে। আগেই বলেছি এই নীতিমালা নির্মাণের ক্ষেত্রে ডিফিকাল্ট। চলচ্চিত্র শিল্প রক্ষায় এই নীতিমালা সংশোধন করা দরকার।

 

প্রদর্শক সমিতির দাবি, কলকাতা আর বাংলাদেশে একসঙ্গে ছবি মুক্তি দিলে তা সফল হবে- এ দাবিকে সমর্থন করেন?

অবশ্যই সমর্থন করি। রপ্তানির বিনিময়ে আমদানির যে নীতিমালা তৈরি হয়েছে তাও অবিবেচনাপ্রসূত। এই নীতিমালার শর্ত পালন করতে গিয়ে নতুন ছবি আমদানিতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়। তাতে ছবিটি সেখানে মুক্তি পেয়ে সিনেমা হল, টিভি, ইউটিউব, নেটে প্রদর্শন এবং পাইরেসি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তা এনে প্রদর্শন করে আমদানিকারক আর সিনেমা হল মালিককে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।  নীতিমালাটি সংশোধন করে দুই বাংলার ছবি উভয় বাংলায় একই দিনে মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

 

সবশেষে চলচ্চিত্র জগতের জন্য কিছু বলবেন?

সবার উদ্দেশে বলব, আপনারা ভালো থাকুন। ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভালো কাজ দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনুন।

 

সর্বশেষ খবর